কভিড সংক্রমণ তীব্রতা হারিয়েছে, মৃত্যুহার কমছে: এখন নীতি কৌশল কী হবে?

মঙ্গলবার | জুলাই ২৮, ২০২০ | ১৩ শ্রাবণ ১৪২৭

আলোকপাত

ড. শামসুল আলম   জুলাই ২৮, ২০২০

কভিড সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং মৃত্যুতে আমরা ভীত-শঙ্কিত। বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও শঙ্কায় অর্থনীতি এখনো গতিহীন। বিশ্বের ২১৩টি দেশে কভিডের সংক্রমণ ঘটেছে। অর্থাৎ কভিডের থাবার বাইরে কেউ নেই। বিশ্বায়ন যে কত গভীরে পৌঁছেছিল, তা কভিড সংক্রমণ আমাদের ভালোভাবে দেখিয়েছে। কোনো কোনো দেশে সংক্রমণ কমেও আবার এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারত, যেটাকে বলা হচ্ছে সংক্রমণের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’। বিশ্বে মোট সংক্রমণ দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। মৃত্যুসংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি। জীবনহানি ছাড়াও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। এসব ভয় ও শঙ্কা নিয়েই সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্রমান্বয়েই উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশেও উদ্বেগ আতঙ্ক নিয়েই অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম উন্মুক্ত করা নিয়ে নাগরিক সমাজের কিংবা থিংক ট্যাংকভুক্ত অর্থনীতিবিদদের প্রথম থেকেই ব্যাপক বিরোধিতা ছিল। জীবন ও জীবিকা রক্ষায় সরকারকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। স্থানিক লকডাউন ও বাজার কার্যক্রম প্রথম সীমিতভাবে হলেও ক্রমান্বয়ে শিথিল করতে হয়েছিল। সার্বিকভাবে এতে অর্থনীতি কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জনসন্তুষ্টিও রয়েছে এতে।

এপ্রিল থেকে জুলাই ২৫ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রেকর্ডকৃত কভিড সংক্রমণ পরীক্ষার ওপর সংক্রমণ হার এবং সংক্রমিতদের মৃত্যুহারের ওপর ভিত্তি করে সংক্রমণের ও মৃত্যুহারের বিশ্লেষণে ‘নীতি গুরুত্বপূর্ণ’ ‘দুটি ধারা’ এখানে তুলে ধরছি। মার্চ ২৫ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া ১ এপ্রিল থেকে ২৫ জুলাই প্রায় ১৫ সপ্তাহের (১১৬ দিন) তথ্য একটি নির্ভরযোগ্য ‘ধারার’ প্রতিফলন ঘটাতে পারে বলে বিশ্বাস করি। কেননা নমুনার ভিত্তি হচ্ছে ১০ লাখ ৯১ হাজার ৩৪ জন, যার ভিত্তিতে সংক্রমণ হার ও সংক্রমিতদের ওপর ভিত্তি করে মৃত্যুহার ধরা হয়েছে। এতে দৃশ্যমান নমুনার সংখ্যা বিশাল। সংক্রমণের সংখ্যা নির্ভর করে পরীক্ষণ সংখ্যার ওপর এবং মৃত্যু সংখ্যাও দৈনিক সংক্রমণের ভিত্তিতে শতকরা হার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছি। সংক্রমণের হার ও মৃত্যুহারকে ন্যাচারাল লগে রূপান্তর করে দৈনিক সময়ের বিপরীতে ‘রিগ্রেশন’ করে ‘এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ ট্রেন্ড’ দেখা হয়েছে। পাঠকের সহজ বোধগম্যতার জন্য প্রাক্কলিত সংক্রমণ ‘বৃদ্ধি হার’ কার্ভটি মাসিক ভিত্তিতে নিম্নে তুলে ধরছি। মাসিক কার্ভটি দেখুন।

১. এপ্রিল ১-৩০ (গ্রাফ: চিত্র ১-চিত্র ৪)

চিত্র ১: কভিড-১৯-এ এপ্রিল ১-এপ্রিল ৩০ পর্যন্ত সংক্রমণের হার

চিত্র ২: কভিড-১৯-এ মে ১-মে ৩১ পর্যন্ত সংক্রমণের হার

চিত্র ৩: কভিড-১৯-এ জুন ১-জুন ৩০ পর্যন্ত সংক্রমণের হার

চিত্র ৪: কভিড-১৯-এ জুলাই ১-জুলাই ২৫ পর্যন্ত সংক্রমণের হার

১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল প্রতি তিনদিনের চলমান গড়ের ওপর কার্ভ এঁকে দেখানো হলো। ‘বৃদ্ধি কমতি’ ধারা কার্ভে স্পষ্টায়নের জন্যই তিনদিনের চলমান গড় দেয়া হয়েছে। এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই প্রতি মাসের জন্য বৃদ্ধি-কমতি কার্ভটি দেখানো হলো। আর একটি ১১৬ দিন বা ১ এপ্রিল থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ১১৬ দিনের ‘মৃত্যুহার বৃদ্ধি/কমতি’ কার্ভে দেখানো হয়েছে (চিত্র-৯)।

সংক্রমণ হার পরিস্থিতি: এপ্রিলে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে সংক্রমণ বেড়েছে, এখানে কার্ভ ঊর্ধ্বগামী এবং সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে ‘সিগনিফিকেন্ট’। সর্বোচ্চ সংক্রমণের হার বৃদ্ধির মাস এপ্রিল। মে মাসে সংক্রমণের হার কমে বৃদ্ধি পেয়েছে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে এবং সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে সিগনিফিকেন্ট।

জুনে এসে সংক্রমণ বাড়ল শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ হারে, যদিও সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে সিগনিফিকেন্ট নয়। তবে স্পষ্ট হলো সংক্রমণের ধার কমেছে এবং জুনে এসে সংক্রমণ কার্ভটি এবার প্রথম ফ্লাট হয়েছে। জুলাইয়ে এসেও সংক্রমণ ‘সিগনিফিকেন্ট’ভাবে ফ্লাট হয়েছে এবং জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে ফ্লাট থেকে নিম্নমুখী ধারায় পতিত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে একজন রোগী এখন একজনের কম ব্যক্তিকে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এটি কভিড আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল, কভিড সংক্রমণের হার জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে নিম্নমুখী এবং সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার টার্নিং পয়েন্ট। সংক্রমণের হার ছিল শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। কভিড ধারা বিশ্লেষণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল।

মৃত্যুহার: মৃত্যুহারের মাসিক কার্ভগুলো দেখানো হলো:

গ্রাফ: চিত্র ৫, চিত্র ৮

চিত্র ৫: কভিড-১৯-এ এপ্রিল ১-এপ্রিল ৩০ পর্যন্ত মৃত্যুহার

চিত্র ৬: কভিড-১৯-এ মে ১-মে ৩১ পর্যন্ত মৃত্যুহার

চিত্র ৭: কভিড-১৯-এ জুন ১-জুন ৩০ পর্যন্ত মৃত্যুহার

চিত্র ৮: কভিড-১৯-এ জুলাই ১-জুলাই ২৫ পর্যন্ত মৃত্যুহার

এপ্রিল: এপ্রিল থেকে কভিডে মৃত্যুহার ‘সিগনিফিকেন্টলি’ নিম্নমুখী এবং এপ্রিলে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমেছে। এপ্রিলে সংক্রমিতদের মোট মৃত্যু ঘটেছে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ। মে মাসে কভিডে মৃত্যুহার সিগনিফিকেন্টলি কমেছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। তবে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মৃত্যুহার কার্ভটি প্রথম ফ্লাটেন হয়েছে, যা জুনে এসে আরো নিম্নগামী হয়েছে। মে মাসে সংক্রমিতদের মোট মৃত্যু ঘটেছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ। জুনে সংক্রমিতদের মোট মৃত্যু ঘটেছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ। জুলাইয়ে সংক্রমিতদের মোট মৃত্যু ঘটেছে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ১ এপ্রিল থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত সংক্রমিতদের মৃত্যুহার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। জুলাইয়ে মৃত্যুহার সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে সিগনিফিকেন্টলি কমেছে ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ হারে। কভিডে মৃত্যুহারের ভয়াবহতা কমেছে জুলাইয়ে এসে।

পুরো সময়ের মৃত্যুহার (নিম্নের কার্ভটির পতন দেখুন)

চিত্র ৯: কভিড-১৯-এ এপ্রিল ১-জুলাই ২৫ পর্যন্ত মৃত্যুহার

মৃত্যুহারের পুরো সময় দেখলে বোঝা যায় এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে মৃত্যুহার নিম্নমুখী শুরু হয়েছে। সেই এপ্রিল থেকে জুলাই সময়ে মৃত্যুহার সিগনিফিকেন্টলি কমে যাচ্ছে। এ সময়ে মৃত্যুহার কমেছে শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ হারে, যা স্ট্যাটিস্টিক্যালি সিগনিফিকেন্ট। এর অর্থ হচ্ছে আক্রান্তদের এখন কমই মৃত্যু হচ্ছে। এটা কমতে থাকবে। উল্লিখিত দুই প্রধান ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রমণ প্রাকৃতিকভাবেই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। টিকা না আসা পর্যন্ত হয়তো সংক্রমণ সীমিত পর্যায়ে থেকে যাবে এবং সংক্রমণ হলেও কদাচিৎ মৃত্যু হবে। বাস্তবত হার্ড ইমিউনিটিতে প্রমাণ মেলে, গ্রাম-গ্রামান্তরে জনগণের মধ্যে সংক্রমণ ব্যাপক বিস্তার ঘটছে না। দরিদ্রপ্রবণ ও বস্তি এলাকায় সংক্রমণ বিস্তারের খবর নেই। খুলে দেয়া গার্মেন্টগুলোয় সংক্রমণের কোনো খবর নেই। জনগণের শক্তিশালী ইমিউনিটি দৃশ্যমান। সাধারণ শ্রমিকশ্রেণী কাজে ফিরেছে। বাজার কার্যক্রম পূর্ণতার দিকে যাচ্ছে। তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী হতে পারে? তার আগে বলে নিই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের তথ্যের ভিত্তিতে এ উপসংহারে আসা। এখানে তথ্য বিশ্লেষণে যা উঠে এসেছে, আমি তা-ই বলেছি। অবশ্য গবেষণার গুরুত্ব যে অপরিসীম, কভিডের ক্রান্তিকালে এটা ভালোভাবে বোঝা যায়। দেশের অণুজীব বিজ্ঞানী ও ভাইরোলজিস্টদের ‘তাত্ত্বিকভাবে নয়’, গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতেই বলা উচিত মিউটেশনের মাধ্যমে জিনগত পরিবর্তন ঘটে কভিড-১৯ বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে পড়েছে কিনা। জাতিকে তাদের জানানো উচিত। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত অর্থনীতিবিদদের সহায়তা নিয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করা।

উপসংহার: কভিড সংক্রমণের প্রাক্কালে এবং এর পর থেকে যে নীতি কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল, অর্থাৎ রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, স্থানিক লকডাউন ও প্রথম দিকে সীমিত পরিসরে বাজার কার্যক্রম চলতে দেয়া, কৃষি শ্রমিক স্থানান্তরে সহায়তা, এই যুগপৎ কৌশলটাকে আমি বলতে চেয়েছি ‘মানবিক লকডাউন’, যার বিপরীত হচ্ছে হার্ড লকডাউন। অর্থনীতিকে প্রথম থেকে সচল রাখার প্রয়াস ছিল বাস্তবমুখী, তা না হলে অর্থনৈতিক চরম মন্দা এবং আয়হীনতার কারণে নীরব দুর্ভিক্ষ এড়ানো কঠিন হতো। মানবিক লকডাউনের কারণে দুর্ভিক্ষ এড়ানো গেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআইজিডির এক সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে ৭০ শতাংশ ক্রস-সেকশন উত্তরদাতা বলেছেন, কভিডকালে সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তারা সন্তুষ্ট। সরকার কভিড ব্যবস্থাপনায় সঠিক পথে রয়েছে। সময়মতো ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিম্নতম।

‘দ্বিতীয় কভিড ঢেউয়ের’ প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধি ব্যাপক লঙ্ঘন, জনবহুল দেশে ব্যাপক জনস্থানান্তর কিংবা জনসমাবেশ কভিড সংক্রমণ সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে অবশ্যই পারে, যদিও মৃত্যুহার হয়তো তেমন বাড়বে না। সংক্রমণ এলাকাগুলোয় লকডাউন কার্যকর রাখতে হবে। মাস্ক-গ্লাভস-শারীরিক দূরত্ব বাধ্যতামূলক। এই তিন মেনে অফিস কার্যক্রম এবং অর্থনীতির সব কার্যক্রম চালাতে সহায়তা করতে হবে। সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্ক, গ্লাভস ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলে খুলে দেয়ার কথা এখন বিবেচনা করা যায়। অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ শক্তিমত্তা ও জনগণের ইতিবাচক সক্রিয়তার কারণে আমাদের অর্থনীতি দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে। বেশি বিলম্ব হলেও ২০২১ সাল হবে আমাদের অর্থনীতির পূর্ণশক্তিতে পুনরুত্থানের বছর।

[নিবন্ধকারের কাছে এ বিশ্লেষণের সব উপাত্ত, গবেষণা পদ্ধতি ও পূর্ণ রিগ্রেশন ফলাফল যে কেউ যোগাযোগ করলে পেতে পারেন। বিশেষভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত টেকনিক্যাল কমিটিকে আমি এই বিশ্লেষণের ফলাফল দিতে আগ্রহী।]

 

ড. শামসুল আলম: অর্থনীতিতে অবদানের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্ত; সদস্য (সিনিয়র সচিব), সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন