নদীতীরে স্থাপনা উচ্ছেদ হলেও নতুন প্রকল্প স্থবির
বেশ তোড়জোড় করে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। নদীর পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধন, ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) নির্মাণসহ নানান পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নদীর জায়গা উদ্ধারের পর পুরো কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। উচ্ছেদের দেড় মাস পেরোলেও সীমানাখুঁটি বসানোর কাজে অগ্রগতি সামান্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছিল সবচেয়ে জটিল কাজ। পদে পদে বাধা এসেছে। তারপরও এই কাজ বেশ দ্রুতগতিতে গুছিয়ে আনা হয়েছে। অধিকাংশ অবৈধ স্থাপনাই উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু এরপর কাজের গতি কমে গেছে। গত দেড় মাসে বলতে গেলে তেমন কোনো কাজই এগোয়নি।
গত জানুয়ারিতে শুরু হয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। জুন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদ-নদীর পাড়ের অধিকাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। পরে ৬ জুলাই স্থায়ী সীমানাখুঁটি বসানোর কার্যক্রম শুরু হয়। ওই দিন কামরাঙ্গীরচরের খোলামোড়া ঘাটে নদীর পাড়ে সীমানাখুঁটি বসিয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তবে উদ্বোধনের পরদিন থেকে ওই কার্যক্রম আর সামনে এগোয়নি।
গত বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচরের মুনসুরবাগের যে অংশে মন্ত্রী খুঁটি বসিয়ে কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন, তা অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। সীমানাখুঁটির রডগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। রডগুলো উন্মুক্ত থাকার কারণে যেকোনো সময় সেখানে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, ওই সীমানাখুঁটিটি মূল সড়কের পাশ ঘেঁষেই বসানো হয়েছে। ঢাকার চারপাশে নদীর পাড় ঘুরে আর কোথাও সীমানাখুঁটি বসানোর কার্যক্রম নজরে পড়েনি।
উচ্ছেদ ও সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্বে আছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, বর্ষা মৌসুম হওয়ার কারণে নদীতে পানির প্রবাহ বেশি। তাই সীমানাখুঁটি বসানোর কাজে দেরি হচ্ছে। আর বিদেশ থেকে উন্নত মানের যন্ত্র আনতেও সময় লাগছে। এ ছাড়া যে স্থানে সীমানাখুঁটি বসানো হবে, তা চিহ্নিত করতেও কিছুটা সময় যাচ্ছে। তাই কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদ-নদীর তীরে প্রায় ৫২ কিলোমিটার এলাকায় সীমানাখুঁটি স্থাপন, হাঁটার পথ, জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) পরিচালক বিআইডব্লিউটিএর সদস্য (অর্থ) মো. নুরুল আমিন। গতকাল রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যৌথ জরিপের মাধ্যমে নদীর যে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত বুধবার কামরাঙ্গীরচরের খোলামোড়া ঘাটে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১৩টি পয়েন্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আজ শুক্রবার আরও ২০ থেকে ২৫টি পয়েন্ট দেখিয়ে দেওয়া হবে। উদ্বোধনের পর দৃশ্যমান কাজ না হলেও আনুষঙ্গিক কাজ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। আসছে সপ্তাহে সীমানাখুঁটির কাজ আবার শুরু হবে বলে তিনি জানান।
প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মাহবুব-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের পর নকশা, ডিপিপি তৈরি, দরপত্র আহ্বানসহ আনুষঙ্গিক কাজে তাঁদের প্রায় এক বছর সময় লেগেছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে সীমানাখুঁটি বসানোর কাজ শুরু হবে। নভেম্বর থেকে বাকি কাজগুলোও শুরু হবে।
প্রকল্পের কলেবর বাড়বে
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে ৮৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এর সঙ্গে আরও কয়েকটি নতুন কাজ যুক্ত হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে মোট ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
এই প্রকল্পের মধ্যে ঢাকার চারপাশের নদ-নদীতীরে ১০ হাজার ৮২০টি সীমানাখুঁটি বসানো হবে। এর মধ্যে ঢাকা নদীবন্দর এলাকায় বসানো হবে ৩ হাজার ৮০৩টি খুঁটি। বাকি সীমানাখুঁটি টঙ্গী বন্দর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরের সীমানায় বসানো হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি পার্কও করার পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে সদরঘাট ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এক কিলোমিটারজুড়ে পর্যটন পার্ক, আশুলিয়া ল্যান্ডিং স্টেশন, মিরপুর বড় বাজার ও টঙ্গী বন্দর এলাকায় ইকোপার্ক করা হবে।
এ ছাড়া কামরাঙ্গীরচর রায়েরবাজার খাল থেকে বছিলা পর্যন্ত আট কিলোমিটার বুড়িগঙ্গা নদীর উভয় তীরে হাঁটাপথ নির্মাণ ও নদীর পাড় বাঁধ দেওয়া হবে। মিরপুর বড় বাজার এলাকায় তুরাগ নদের উভয় তীরে আট কিলোমিটার, টঙ্গী এলাকাতে পাঁচ কিলোমিটার, ফতুল্লার ধর্মগঞ্জে পাঁচ কিলোমিটার, নারায়ণগঞ্জের ডিপিডিসি এলাকায় ছয় কিলোমিটার, নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকায় ছয় কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ করা হবে। হাঁটার পথ নির্মাণের পাশাপাশি এসব এলাকায় বাঁধ নির্মাণ, বনায়ন ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা থাকবে।
উচ্ছেদকৃত তীরভূমিতে ১৯টি আরসিসি জেটিও নির্মাণ করবে সংস্থাটি। এর মধ্যে ঢাকা নদীবন্দরের সীমানার মধ্যে ১০টি এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরের সীমানা নয়টি জেটি নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের মধ্যে সদরঘাট থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার এলাকায় ৪ মিটার করে নদী খননও করা হবে। ১০০ মিটার করে প্রশস্ততা বাড়ানো হবে।