ক্ষতিপূরণের টাকা পেতেও ঘুষ
• চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেল প্রকল্প
• জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র
• কঠোর হওয়ার কথা বললেন বিভাগীয় কমিশনার
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার নির্মাণাধীন রেললাইনের ভূমির মালিকেরা ঘুষ দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন। ঘুষের চেক আদায়ের জন্য গড়ে উঠেছে একটি দালাল চক্র। ক্ষতিপূরণের চেক দেওয়ার আগমুহূর্তে ভূমির মালিকদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ কমিশনের চেকে সই আদায় করে নেওয়া হয়। ব্যাংকে ক্ষতিপূরণের টাকা নগদায়ন হলে কমিশন বা ঘুষের টাকা তুলে নেওয়া মূলত দালালদের কাজ।
ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তিন দালালকে কমিশনের চেকসহ হাতেনাতে ধরলেও এক দিনও আটকে রাখতে পারেনি। ফলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রের কাছে ভূমির মালিকেরা অসহায়। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এই চক্রের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন বলে জানিয়েছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ভূমির ক্ষতিপূরণ বাবদ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে ২ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিভিন্ন কিস্তিতে মোটা দাগে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করা হয়। নতুন রেললাইন নির্মাণের জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামে ৩৬৫ একর এবং কক্সবাজারে ১ হাজার ৩৬৯ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য এই অর্থ পরিশোধ করে।
জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেললাইন রয়েছে। এ কারণে এ প্রকল্পের ভূমি–সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ শেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, তা জেলা প্রশাসনের এখতিয়ার।
রেলের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের সমুদয় টাকা দুটি জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের সব জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। কেন বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না, তা জানি না।’
রেল সূত্র জানায়, ভূমি বুঝিয়ে দিতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পের কাজও দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু টাকা বুঝিয়ে পেলেও জেলা প্রশাসনের কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হয়রানি করছে বলে অভিযোগ ওঠে। যাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে আসছেন, তাঁদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন (ঘুষ) কেটে রাখার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দালালদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ আছে। একাধিক ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণের চেক নিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন। তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ গত সেপ্টেম্বরে তিন দালালকে আটক করেছিল। তাঁদের কাছ থেকে কমিশনের আটটি চেক ছাড়াও একটি ফর্দ উদ্ধার করা হয়। ওই ফর্দে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নাম এবং কমিশনের ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকার বর্ণনা ছিল।
আটক দালালেরা হলেন আবদুল্লাহ ভুঁইয়া, আইয়ুব আলী ও তপন নন্দী। চট্টগ্রাম নগরের হাজারী গলি এলাকার রূপালী ব্যাংকের সামনে থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁরা আটক হন। তাঁদের আটকের খবরে জেলা প্রশাসনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের ছাড়িয়ে আনতে পুলিশ প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় বলে একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত গোপন রাখা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধে না জড়াতে এই তিন দালালকে ওই দিন আদালতের মাধ্যমে মুক্ত করা হয়। অর্থাৎ পুলিশ আটক দালালদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অভিযোগ আদালতে উত্থাপন করেনি। এ কারণে তাঁদের জামিন পাওয়ায় সমস্যা হয়নি।
তিন দালাল আটক–সংক্রান্ত একটি গোপন প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে দেন অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশের একজন উপপরিদর্শক (এসআই)। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ভূমির মালিকেরা জেলার ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা থেকে ক্ষতিপূরণের চেক সংগ্রহ করতে গেলে ১০ শতাংশ টাকা (ঘুষ বা কমিশন) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বকশিশ হিসেবে দিতে হয়। এই দালালেরা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদেরও আর্থিকভাবে লাভবান করে দেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন।
প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ১১ কর্মচারীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। তাঁরা সবাই জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী, সার্ভেয়ার, হিসাবরক্ষক ও কানুনগো।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কর্মচারীদের অনেকে চোর। এরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে কমিশন হাতিয়ে নিচ্ছে না, ওয়ারিশ খুঁজে মামলা ঠুকে দিতে ভূমিকা রাখছে।’ তিনি বলেন, শুধু রেলওয়ের জায়গা নয়, যত জমি অধিগ্রহণ হয়, সবার কাছ থেকে কমিশন হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়নি। তিনি আরও কঠোর হতে চান। তাই বিষয়টি ভূমিমন্ত্রীর নজরেও এনেছেন। ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
আটক তিন দালালের ব্যাপারে তদন্ত কতটুকু অগ্রসর হয়েছে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিনজনকে কাগজপত্র, চেকসহ ধরে আদালতে সোপর্দ করেছিলাম। এর তদন্ত সম্পর্কে এ মুহূর্তে আমার কিছু জানা নেই।’
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অন্তত সাত–আটজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়। তাঁদের কাছ থেকে দালালেরা ১০ শতাংশ হারে ঘুষের টাকা কেটে নিয়েছেন বলে জানান। সাতকানিয়ার কালিয়াইশ এলাকার রক্ষিত বাড়ির একজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ করার পর তাঁদের ক্ষতিপূরণ ৩০ লাখ টাকার পরিবর্তে ২৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়। একই এলাকার আরেক বাসিন্দা তাঁর ১৪ দশমিক ৫০ শতক জমি বাবদ ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকার পরিবর্তে সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা পেয়েছেন।