৫-৬ মে হেফাজত ফ্লাশআউট অপারেশনের ২৪ ঘণ্টা : আলেমদের লক্ষ্য করে ১ লাখ ৬৫ হাজার : বুলেট গ্রেনেড টিয়ারশেল ছোড়ে র্যাব-পুলিশ
৫ মে সকাল ১১টা থেকে ৬ মে সকাল ১১টা। পাক্কা ২৪ ঘণ্টা। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে রাজধানী ঢাকায় জড়ো হওয়া নিরস্ত্র আলেম-ওলামাদের ওপর আওয়ামী সরকারের লেলিয়ে দেয়া সরকারি যৌথবাহিনীর নির্বিচার বুলেট টিয়ারশেল ও গুলি বর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞের এক কালো অধ্যায় রচনা করেছে। মহান আল্লাহতায়ালা, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ও পবিত্র কোরআনের অবমাননার প্রতিবাদসহ ১৩ দফা দাবিতে সরকারের অনুমতি নিয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছিলেন এই আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন কওমি মাদরাসার কোমলমতি অসংখ্য শিশু-কিশোর ও বয়োবৃদ্ধ মানুষ। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এসব মানুষের ওপর বর্বর গণহত্যা চালায় সরকারের লেলিয়ে দেয়া যৌথবাহিনী। বিশেষ করে ৫ মে রাত আড়াইটায় শাপলা চত্বর থেকে প্রায় এক লাখ লোককে তাড়িয়ে দিতে বাতি নিভিয়ে ব্লাক-আউট ও ক্রাকডাউন করে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ যৌথবাহিনী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন। সরকারি চাপে ইলেকট্রনিক তথা প্রিন্ট মিডিয়ায় (জাতীয় দৈনিকগুলো) সরকারি বাহিনীর গণহত্যার খবর চেপে গেলেও শতাধিক হেফাজতকর্মীকে হত্যা ও দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহারের খবর চাপা থাকেনি। ১২ মে রোববারের যুগান্তর পত্রিকায় ৬ কলামে লিড খবরের শিরোনাম ছিল ‘দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার, হেফাজত দমনে সরাসরি অংশ নেয় ৭ হাজার ৫৮৮ সদস্য’। এতে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর বরাত দিয়ে বলা হয় ৫ মে’র ওই অপারেশনে ১ লাখ ৫৫ হাজার গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ৫ মে সকাল থেকে রাতে শাপলা চত্বরের অভিযান পর্যন্ত সময়ে গোলাবারুদ খরচের হিসাব। ৬ মে ঢাকার প্রবেশদ্বার কাঁচপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সানারপাড় এলাকা থেকে হেফাজত কর্মীদের হটিয়ে দিতে মাত্র দু’ঘণ্টায় আরও প্রায় ১০ হাজার গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছিল, তার হিসাব আসেনি এ খবরে। যদিও ৬ মে চ্যানেল ২৪, ইন্ডিপেনডেন্ট ও ইটিভির খবরে এ হিসাব দেয়া হয়েছিল। একইদিনে হাটহাজারী ও বাগেরহাটে হেফাজতকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ব্যবহৃত গোলাবারুদসহ সারাদেশে হেফাজতকর্মীদের শায়েস্তা করতে ব্যবহৃত গোলাবারুদের সংখ্যা যোগ করলে সেটা ২ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে যুগান্তর জানায়, ৫ মে দুপুর থেকে পরদিন ৬ মে ভোর পর্যন্ত ৮০ হাজার টিয়ারশেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, ১৫ হাজার শর্ট গানের গুলি এবং ১৫ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে পিস্তল রিভলবারের গুলি ব্যবহৃত হয়েছে সাড়ে ৩শ’ রাউন্ড। এটা সরকারি হিসাবে।
আমার দেশ-এর ছাপা বন্ধ, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ১৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া, মতিঝিল গণহত্যার ছবি প্রচারের মুহূর্তে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর প্রচারে সরকার যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে তাতে মিডিয়াগুলো একেবারে কাবু হয়ে গেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ মিডিয়া সরকারি দলের মালিকানাধীন হওয়ায় এমনিতেই মিডিয়ায় সরকারের বিপক্ষে যায় এমন খবর খুবই কম ছাপা হচ্ছিল। তার ওপর মিডিয়া নিয়ে সরকারের হার্ডলাইনের ফলে সরকারি নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, দলবাজির খবর পত্রিকার পাতা থেকে উধাও হয়ে গেছে।
তারপরও বাংলাদেশের মিডিয়ায় যেটুকু খবর প্রচার হয়েছে তাতে দেখা গেছে, ৫ মে দিনের বেলা হেফাজতকর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে মিছিল নিয়ে মতিঝির শাপলা চত্বরে প্রবেশ করছিল তখন ৩২ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র হেফাজতকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। খবর পেয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ে আগেই জড়ো হওয়া হেফাজতকর্মীরা এগিয়ে যেতে চাইলে স্টেডিয়ামের কাছে ও বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে পুলিশ তাদের প্রতিরোধ করলে সংঘর্ষ বাধে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে দক্ষিণ গেট পর্যন্ত এ সংঘর্ষ ছড়ায়। বেসরকারি টিভি চ্যানেল আই ও যুগান্তর পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় আওয়ামী লীগের পিস্তলধারী বহু লোকের ছবি প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা দুজন হেফাজতকর্মীকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছে। যার ছবি প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে। এই ঘটনা ২০০৬ সালে লগিবৈঠা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বামদের হাতে জামায়াত-শিবিবের ৮ নেতাকর্মীকে (পরে মৃত্যুবরণকারী আরও ৪ জনসহ ১২জন) রাজপথে পিটিয়ে হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একইভাবে পুরানা পল্টন এলাকায় হেফাজতকর্মীদের শাপলা চত্বরে প্রবেশে বাধা দিতে গিয়ে দিনভর সংঘর্ষ হয়। একই প্রক্রিয়ায় শাপলা চত্বরের বিভিন্ন প্রবেশপথে হেফাজতকর্মীদের প্রবেশে বাধা দিতে গিয়ে পুলিশ ও সরকারি দলের লোক হেফাজকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর অভিযানে ঠিক কতজন নিহত হয়েছে তার পরিসংখ্যান নিশ্চিত করে জানা যায়নি। দেশি-বিদেশি অনেক মিডিয়া এ রাতে গণহত্যা চালিয়ে অগণিত নিরস্ত্র ঘুমন্ত আলেম ওলামা, মাদরাসা শিক্ষক ও মাদরাসার শিশু কিশোর ছাত্রকে হত্যার কথা জানিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম বলেছে, ৫ মে রাতে গণহত্যা চালানোর পর তাদের ৩ হাজার নেতা ও সমর্থক হত্যার শিকার ও নিখোঁজ রয়েছেন। বিএনপি বলেছে, গণহত্যার শিকার সহস্রাধিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাত দিয়ে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বরেছেন, আড়াই হাজার লোক হত্যার শিকার হয়ে থাকতে পারেন। মানাধিকার সংগঠন অধিকার বলেছে, শত শত লোক এই গণহত্যার শিকার। নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবির টেলিভিশন টকশোতে বলেছেন, তার রিপোর্টরাদের খবর ও ওয়াকিবহাল সূত্র মতে কমপক্ষে একশ’ লোক নিহত হয়েছে। বাংলার চোখের ফটো সাংবাদিক নইম পারভেজ অপু এই অভিযানে নটর ডেম কলেজ অংশ থেকে হাটখোলা পর্যন্ত যৌথবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, অন্তত ৫১টি নিথর ও রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে থাকতে তিনি দেখেছেন। তবে তিনি এও জানিয়েছেন, পুরো অভিযান চলেছে তিন দিক থেকে, আরও ব্যাপক এলাকা ও সময়জুড়ে-যা তিনি দেখতে পারেনি। বিশেষ করে দৈনিক বাংলা মোড়, দিলকুশা এলাকায় কী হয়েছে তা দেখার সুযোগ তার হয়নি। ইনকিলাবে ফটো সাংবাদিক নান্টু সহকর্মীদের জানিয়েছেন, তিনি রাতে অপারেশন শুরুর সময় মঞ্চে থাকলেও মঞ্চ দখলের পর যৌথবাহিনী তাকে ছবি তুলতে দেয়নি। বরং একটি গলির ভেতর আরও বহু হেফাজতকর্মীও সঙ্গে মাতা নিচু করে সকাল ৬টা পর্যন্ত বসে থাকতে বাধা করে। আমার দেশ-এর রিপোর্টার গালিবের ভাষ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ভবনের সিঁড়িতে ব্যাপক গুলিবর্ষণের দৃশ্য তিনি দেখেছেন। কিন্তু যৌথ বাহিনী তাদের এক জায়গায় ডিটেইন করে রাখাতে সকাল ৬টার আগ পর্যন্ত স্পটগুলো সরাসরি দেখার সুযোগ তার হয়নি। এরই মধ্যে লাশগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। তবে তিনি রাজউক ভবনের পাশ দিয়ে বঙ্গভবনের দিকে পলায়নরত হেফাজতকর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরাসরি গুলি চালাতে দেখেছেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে ৪৪ জনের মৃতদেহের ছবি রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের বিজয়নগর ও শাহজাহানপুরের দু’টি হাসপাতাল, বারাকা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে হতাহতদের নেয়া হলেও ২২ মামলায় লক্ষাধিক হেফাজতকর্মীকে আসামি করার পর ভয়ে প্রায় সবাই পালিয়ে আত্মগোপনে গেছেন। ঢাকা মেডিকেলের হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন কর্মকর্তা টিভি সাংবাদিকদের কাছে ১১ মে নিহতদের ১১ জনকে মেডিকেলে আনার কথা জানালেও পরে তিনি আর মুখ খোলেননি। একুশে টিভি ৬ মে ভোর ৪টার খবরে শাপলা অপারেশনে ৫ জনের নিহত ও অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর প্রচার করলেও ২০ মিনিটের মাথায় দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি সরকার বন্ধ করে হতাহতের খবর প্রচার বন্ধ করে দেয়। সরকারিভাবে কোনো হত্যাহতের কথা প্রথমে অস্বীকার করা হলেও ডিএমপি কমিশনারের ব্রিফিং ও প্রেসনোটে মাত্র ৩ জনের হত্যার কথা স্বীকার করা হয়েছে। ৫ মে সকাল থেকে ৬ মে ভোর পর্যন্ত একজন পুলিশ সদস্যসহ মোট ১১ জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে সরকার। এর মধ্যে দিনে নিহত ৩ জন ঢাকা মেডিকেলে ছিল। দিনে নিহত আরও ৪ জনের লাশ শাপলা চত্বরের মঞ্চের কাছে পাওয়া গেছে। অপারেশনের পর এলাকা থেকে আরও ৩টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে এবং হামলার শিকার হয়ে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে-এই নিয়ে মোট ১১ জনের কথা বলা হয়েছে সরকারি ভাষ্যে। আর ৬ মে দিনে কাঁচপুর এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় ২ জন বিডিআর, ২ জন পুলিশসহ ১৩ জন নিহতের কথা স্বীকার করা হয়েছে।
প্রথম আলোর ভাষ্য অনুযায়ী, ৫ মে দিনের ঘটনায় ১১ জন রাতের ঘটনায় স্পটে ১১ ও পরে আরও একজনসহ মোট ২৩ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া ৬ মে দিনে কাঁচপুর এলাকায় আরও ১৭ জন নিহত হয়েছে। ৫ মে রাতের অভিযানে শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর অভিযানের আগ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের হামলায় ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর সে রাতে প্রচার করে একুশে টিভি। দিগন্তসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায়ও এ খবর প্রচারিত হয়। তবে হেফাজত সূত্রের বরাত দিয়ে সর্বোচ্চ ২৪ জনের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয় মিডিয়ায়।
শাপলা চত্বরের অপারেশনে কয়েশ’ লোকের মৃত্যুর পাশাপাশি ৬ মে ঢাকার প্রবেশপথ কাঁচপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪ জনসহ ২৯ জন, হাটহাজারীতে একই দিনে ৭ হেফাজতকর্মী ও বাগেরহাটে দু’জন হেফাজতকর্মী নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় এ খবর প্রচারিত হয়েছে।
সরকারি প্রেসনোটে নিহতদের কোনো পরিচয় দেয়া হয়নি। আহতদের সংখ্যা বা পরিচয় কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। গণহত্যার ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন ও অথবা আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি তুলেছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি।