হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
(দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপ সম্পাদকীয় কলাম)
শিরোনামের বাক্যটি কবি নজরুল ইসলামের ‘খুকী ও কাঠবিড়ালী’ নামের সেই বিখ্যাত কবিতার একটা মজার পঙ্ক্তি থেকে নেয়া। কাঠবিড়ালীর সাথে অনেক চেষ্টা করেও কোনো ধরনের ভাব জমাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে খুকীকে এই অভিশাপটুকু দিতে হয়েছিল। এই খুকীর মতোই নিরুপায় হয়ে পড়েছে এ দেশের জনগণ। এক কাঠবিড়ালী তাদের সুখের পেয়ারাটুকু খেয়ে ফেলছে। কোনো গালিগালাজেও এই কাঠবিড়ালীকে তাড়ানো যাচ্ছে না। লাজলজ্জা ঘেন্না পিত্তি কোনো কিছুই নেই এই কাঠবিড়ালীর।
দেশের দু’টি প্রধান শহরের তিনটি মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশবাসী এই ধরনের একটি প্রার্থনা মনে মনে আওড়াচ্ছে। সবাই জানে স্থানীয় পরিষদের এই মেয়র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে এই চতুর কাঠবিড়ালীকে সরানো যাবে না সত্য, কিন্তু একটা পোকা অন্তত এই কাঠবিড়ালীর পেটে ঢুকাতে পারবে বলে দেশবাসী বিশ্বাস করে। এই পোকাটি বাকশাল নামের কাঠবিড়ালীর পেটে ঢুকে গেলে খুব আরাম করে আমাদের সুখ নামের পেয়ারাটি ভক্ষণ করতে পারবে না।
খুকীর মতোই এ দেশের মানুষ কোনো কোনো নেত্রীর অনেক তোষামোদ করেছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয়নি। তিনি এরপরও বাকশালের দিকেই পা বাড়িয়েছেন। যে দেশের মানুষ খাবারের চেয়ে কথা বলায় বেশি টাকা খরচ করেন; সেই দেশের মানুষের মুখ বন্ধ করতে চাচ্ছে এ সরকার। যে দেশের মানুষ উনিশ শতকের প্রথম থেকেই নির্বাচন করে এসেছে; সেই দেশের মানুষকে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের নতুন সবক শেখাচ্ছে! এ দেশের মানুষ গতরের সব যন্ত্রণা লাঘবের একটু খানি সুযোগ শুধু খুঁজছে।
সোনার ছেলেরা প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে তিন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে হামলা করেছে। বর্তমান ডিজিটাল জমানায় সেই ভিডিও চিত্র আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তারপরও আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেটাকে বেগম খালেদা জিয়ার নাটক বলে অভিহিত করেছেন। পর পর তিন দিন আতঙ্কিত দেশবাসী বেগম জিয়ার সেই ‘নাটক’টি প্রত্যক্ষ করেছেন! ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যেসব সদস্য এই হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন ভিডিও প্রমাণসহ তাদের নাম পত্রপত্রিকায় এসেছে। এ দেশের মানুষের আইকিউ এত নিচে নেমে যায়নি যে, এরা খালেদা জিয়ার এই নাটকটি ধরতে সক্ষম হচ্ছেন না!
‘দেশের মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার ওপর মারাত্মকভাবে ক্ষেপে গেছে’ এই বিষয়টি সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা। তাদের এই কথায় নিজেরা কতটুকু বিশ্বাস করেন তা-ও দেশবাসী মালুম করে ফেলেছেন। কারণ বেগম জিয়ার ওপর জনতার ক্ষোভ প্রমাণের জন্য মেয়র নির্বাচনটিই তাদের জন্য মোক্ষম একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল। গত আন্দোলনের সময় গাড়ি পোড়ানোয় ক্ষুব্ধ জনগণ এই নির্বাচনের মাধ্যমেই বেগম জিয়াকে একটি উপযুক্ত জবাব দিতে পারত। নির্বাচনী মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে সেই প্রমাণটি আরো পোক্ত হতো। বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার ওপর জনগণ কতটুকু ক্ষুব্ধ তা প্রমাণের সেই মহা সুযোগটি সরকার হেলায় নষ্ট করে ফেলেছে!
মানুষ ভালোভাবেই টের পেয়েছে, এ দেশে এখন সুয়োরানী দুয়োরানীর খেলা চলছে। বেশির ভাগ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে কব্জা করেও সরকার তার কথাগুলো দেশের জনগণকে গেলাতে পারছে না। বরং সব কিছুই শেষমেশ কেমন যেন বুমেরাং হয়ে পড়ছে।
কোনো একটা অপকৌশল দিয়ে কিছু মানুষকে অল্প দিনের জন্য বিভ্রান্ত করে রাখা সম্ভব হলেও কিছু দিন পর অন্য একটি ঘটনা আগের ঘটনার পেছনের রহস্যটি স্পষ্ট করে তুলছে। এ দেশের যে আবদুলেরা সরকারের ভেলকিবাজি বা কারসাজি বুঝতে পারত না বা তা বুঝতে চেষ্টা করত না- তারাও এবার বুঝে ফেলেছে সিঙ্গারার ভেতরে আলুটি কিভাবে ঢুকেছিল।
সোনার ছেলেরা বিরোধী জোটের নেত্রীর গাড়িতে সরাসরি হামলা করেছে। আর সেটাকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আক্রান্তের নাটক। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে কাম উপদেষ্টা বলেছেন, বেগম জিয়ার প্রতি এটা ক্ষুব্ধ জনতার রুদ্ররোষ। একটি মিথ্যাকে সত্য বলে চালানোর জন্য যে সমন্বয় দরকার- তার অভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয় দুজনের এই জবানিতে। দেশের জনগণ ইতোমধ্যে যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কিছু দিন আগের বাস পোড়ানোর মাজেজাটুকুও দেশের জনগণের কাছে আরেকটু খোলাসা হয়ে পড়েছে।
এরপরও গলাবাজি থেমে যায়নি। সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়ার বক্তব্য সম্পর্কে শেখ হাসিনা পাল্টা মন্তব্য করেছেন, খালেদা জিয়া মিথ্যার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। অথচ অসত্য কথা বলে হাতেনাতে ধরা খাওয়ার রেকর্ড এখন পর্যন্ত সংখ্যায় ও মাত্রায় কার বেশি? অনেক ঘটনায় তিনিই হয়েছেন প্রথম মন্তব্যকারী। সেসব মন্তব্য কিছুক্ষণ পরেই জনগণের সামনে অত্যন্ত করুণভাবে ভিত্তিহীন বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দুই বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু দেশবাসী সেই তটি আজো ভোলেনি। যুবলীগের সন্ত্রাসীরা বিরোধী দলের হরতাল অকেজো দেখানোর জন্য হতভাগা শ্রমিকদেরকে জোর করে ফাটল দেখা দেয়া বিল্ডিংয়ে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু রানা প্লাজা ধসে পড়ার সাথে সাথেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘রানা প্লাজায় বেশি মানুষ আটকে নেই, কয়েকজন শ্রমিক তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গিয়ে আটকা পড়েছে মাত্র।’ পরে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে এক হাজারের ওপর লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। কয়েক হাজার আহত শ্রমিককে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আরো কয়েক শত নরনারী নিখোঁজ রয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী এমন একটি কথা বলে ধরা খাওয়ার পরেও কোনো দুঃখ প্রকাশ করেননি। রানা প্লাজার সেই ‘রানা যুবলীগের কেউ না’ বলে সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন। পরে সেই রানার কপালে আওয়ামী লীগের এমপি মুরাদ জংয়ের স্নেহের চুম্বন দেখিয়ে দেয় যে রানা আসলে কে ছিলেন।
২০০১-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে এক কোটি তরুণের প্রতি বিশেষ আহ্বান জানিয়েছিলেন চিরতারুণ্যের প্রতীক স্বনামধন্য সাংবাদিক, কলামিস্ট ও জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক শফিক রেহমান। এমন ধরনের একটি আহ্বান আবারো জরুরি হয়ে পড়েছে। তার সেই আহ্বানে দেশের তরুণসমাজ যথাযথ সাড়া দিয়েছিল। সেই এক কোটি তরুণের সবাই আজ তারুণ্যের প্রান্তসীমায় কিংবা প্রৌঢ়ত্বে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের কর্তব্য হলো নতুন কয়েক কোটি তরুণের কাছে সেই মেসেজটি ট্রান্সমিট করা। এটি কোনো বিশেষ দলকে ক্ষমতায় আনা বা কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য নয়। এই আহ্বান দরকার খোয়া যাওয়া গণতান্ত্রিক সিস্টেমটি পুনরুদ্ধার করার জন্য।
মেয়র নির্বাচন মূলত একটি স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন। তবে অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের এই নির্বাচনটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটা বিশেষ প্রভাব রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই নির্বাচনটি আমাদের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে। এখান থেকে দু’টি রাস্তা জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। একটি রাস্তা আমাদের এই দেশটিকে আবারো গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। অন্য রাস্তাটি স্বৈরাচার বা একদলীয় ব্যবস্থার এক অন্ধকারময় গুহার দিকে দেশকে টেনে নিতে পারে। ছেলেধরা চকোলেট দিয়ে বা মিষ্টি কথা বলে যেমন ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যায়; এই ব্যক্তিরাও মিষ্টি কথা বলে বা সমাজের কোনো কোনো অংশে চকোলেট বিলিয়ে পুরো জাতিকে বাকশালের খাঁচায় আটকে ফেলতে চাচ্ছে। এখনই সময় এদের হাত থেকে ছোটার।
আমাদের দেশে কখনো বিশুদ্ধ গণতন্ত্র কিংবা শতভাগ শুদ্ধ রাজনৈতিক আচার বিদ্যমান ছিল- এই ধরনের দাবি করা যাবে না। আমাদের গণতন্ত্রে বা রাজনৈতিক আচরণে বা সংস্কৃতিতে অনেক ত্রুটি ছিল, অনেক বিচ্যুতি ছিল। তারপরও পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ন্যূনতম একটা মাত্রা বজায় ছিল। বিরোধী দলের সব রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী মোটামুটিভাবে দেশের ভেতরেই অবস্থান করতে পারতেন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারতেন। কিন্তু এবার দেশটিকে আবার ৪০ বছর পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিরোধীপক্ষ মানেই শত্রু- এই ক্ষতিকর ভাবধারাটি ফিরে এসেছে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ছিল বিরোধী দলের ওপর লাল ঘোড়া দাবড়ানোর সময়। আবার ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া ড. কামাল হোসেনকে পাঠিয়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিরোধীপক্ষকে সহ্য করার ধারাটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রবিষ্ট করিয়েছিলেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক নিজেই নিহত হন।
এরপরে এরশাদ স্বৈরাচারী হিসেবে চিহ্নিত হলেও রাজনৈতিক বিরোধিতাকে পুরোপুরি খতম করে ফেলেননি। সেই স্বৈরাচার হটানোর পরে গণতন্ত্রের অভিমুখে আরেক ধাপ উত্তরণ ঘটল। ২০০৫ পর্যন্ত এই ধারাটি মোটামুটি অব্যাহত থাকে। বারবার বলছি, সেটুকু নিয়েও দেশবাসী সন্তুষ্ট ছিলেন না। গণতন্ত্রকে নিয়ে সামনে যাওয়ার একটা তাগিদ অনুভব করেছেন দেশবাসী। সে রকম একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু এখন সামনে যাওয়া তো দূরের কথা, আমাদের সেই যৎসামান্য অর্জনটুকুও পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিকাশের যেখানে ছিলাম সেখান থেকেও হঠাৎ অনেক পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
সেই ধ্বংস থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ মেয়র নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে সচেতন অংশের বসবাস ঢাকা ও চট্টগ্রামে। তারা সঠিকভাবে তাদের ভোট দিয়ে মেকি গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারেন। এটি হতে পারে সবচেয়ে কম খরচে ও কম শ্রমে এ দেশ থেকে অপশক্তি তাড়ানো।
তজ্জন্য খুকীর মতো ‘একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে’ কামনা করলেই হবে না। সেই পোকাটি ঢুকানোর সক্রিয় উদ্যোগ সবাইকে নিতে হবে। সবাইকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে। সরকারের কোনো অশুভ পরিকল্পনা থেকে থাকলে যতটুকু সম্ভব তা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে হবে। সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমে তা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। যারা এই তিনটি শহরের বাইরে রয়েছেন তারাও এই তিনটি শহরের মধ্যে অবস্থানরত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এই লক্ষ্যে আপনার একটি ফোনের মানে হলো একটি পোকা এই কাঠবিড়ালীর পেটে ঢুকিয়ে দেয়া।