ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘টক ঝাল মিষ্টি’ সম্পর্ক চলছে। সরকারকে ব্যর্থ হতে দিতে চায় না বিএনপি, আবার তাদের কাজেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় দলটি। সংবিধান সংস্কার প্রশ্নেও বড় দ্বিমত রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সমর্থন করলেও কাজে পুরোপুরি খুশি নয়।
তবে কোনো দলই সরকারের সরাসরি বিরোধিতা করছে না। নেতারা বলছেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঘাটতি রয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কম থাকায় কোনো কাজই ঠিকভাবে করতে পারছে না। তবে ভুল হলে, উপদেষ্টারা যে ক্ষমা চাইছেন– একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন নেতারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত সরকারের ১০০তম দিন আজ শনিবার। হাজারো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়। পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিন শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এর তিন দিন পর শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্ণধাররা সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সম্পর্ক রাখার কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন। কীভাবে, কোন যোগ্যতায় উপদেষ্টা নিয়োগ করা হচ্ছে– এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। সরকারের আরেক রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় নাগরিক কমিটিও অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে মন্থরগতির সমালোচনা করছে প্রকাশ্যেই।
ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ সরকারের সমালোচনায় সবচেয়ে মুখর। তবে এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদের অপর অংশ সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন করছে।
গত ১০০ দিনে বিএনপির সঙ্গে চারবার, জামায়াতের সঙ্গে তিনবার এবং অন্যান্য দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে সরকার। নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সংস্কারের প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির। বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সরাসরি বিরোধিতায় যেতে চাচ্ছে না দলটি।
১০০ দিনে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় মতপার্থক্য দেখা গেছে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ইস্যুতে। সরকারের কয়েক উপদেষ্টা এবং অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে বঙ্গভবনছাড়া করতে চাইলেও সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কা দেখিয়ে বিএনপি তা হতে দেয়নি। জামায়াত এবং চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ছাত্র নেতৃত্বের পক্ষ নিলেও বিএনপির অসন্তুষ্টির কথা ভেবে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়নি। সরকারের সমর্থক দুটি দল বাদে অন্যরা বিএনপির সুরে কথা বলে। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে নিজের শক্তি সরকারকে দেখিয়েছে বিএনপি।
দলটি এখন দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের দাবিতে কাজ করছে। দাবির সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে সভা-সেমিনারে বক্তব্যের পাশাপাশি ধীরে চলো নীতিতে রাজপথের কর্মসূচিতেও নামছে দলটি। আগামী মাস থেকে এসব দাবির পক্ষে ১০ বিভাগীয় শহরে নানা কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি সমমনা অন্য দলগুলোকেও একই ইস্যুতে মাঠে সরব করার পরিকল্পনা দলটির রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি নেতারা জানান, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই নির্বাচনী সড়কে উঠতে চান তারা। এ জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল বজায় থাকবে। তবে এখনই সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়াবে না।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদের ১৫ বছরের আন্দোলনের ফল শেখ হাসিনার পতনের অভ্যুত্থান। দলের নেতাকর্মীরা অকাতরে শহীদ হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিএনপি মুক্তভাবে দলীয় কর্মকাণ্ড চালাতে পারলেও রাজনৈতিক ‘খেলা’ এখনও শেষ হয়নি।
বিএনপি নেতাদের সন্দেহ, সরকারের একাংশ নির্বাচনকে বিলম্বিত করে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করতে পারে। বিএনপিকে ‘মাইনাস’ করার চেষ্টাও হতে পারে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বিরাজনীতিকরণ এবং ‘মাইনাস ফর্মুলার’ আশঙ্কার কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ‘দোসরদের’ প্রশাসনে পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলেও বিএনপি নেতাদের অভিমত। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, নির্বাচনে জালিয়াতি, গুম-খুন, অর্থ পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সর্বোপরি জুলাই গণহত্যার কুশীলবদের আইনের আওতায় আনার কাজে গতি নেই বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যেও নাশোখ বিএনপি। দলটির নেতাদের ভাষ্য, এসব বক্তব্যে মনে হচ্ছে উপদেষ্টারা বিএনপিকে প্রতিপক্ষ মনে করছেন। তবে নতুন প্রশাসনকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল মনে করায় সরকারকে ব্যর্থ হতে দিতে চায় না বিএনপি। দলটির নেতাদের মূল্যায়ন, ইউনূস সরকার ব্যর্থ হলে দায় নিতে হবে বিএনপিকেই। এতে আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, ক্ষমতাচ্যুত শক্তিও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এ দায়ও নিতে হবে বিএনপিকে। তাই ভালো না লাগলেও ইউনূস সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তবে তা অনির্দিষ্ট সময় হতে পারে না। সরকারকে নির্বাচনের সময়সীমা জানাতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ৫ আগস্ট ছিল জনগণের বিপ্লব। এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত। সুতরাং মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ। একাত্তরের পরে আমরা অনেকবারই সুযোগ হারিয়েছি। এবার সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়তে হবে।
সরকারের পাশাপাশি অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব এবং জামায়াতের তৎপরতা এবং সরকারের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতাকে’ সন্দেহের চোখে দেখছেন বিএনপি নেতারা। তবে বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, স্থিতিশীল পরিস্থিতি নিশ্চিতে কারও সঙ্গে বিরোধে যাবে না। ছাত্র নেতৃত্ব এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক দল গঠন করলে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা হবে।
৫ আগস্টের পর বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব রেখে হাঁটতে শুরু করেছে জামায়াত। সংবিধান সংস্কার এবং আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে ইসলামপন্থি দলটি। বিএনপি এর বিরোধী। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি নতুন যে দুই উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের একজনের বিষয়ে জামায়াত নাখোশ। সংস্কার কমিশনগুলো মতামত চেয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করলেও সরকার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্স সম্পর্কে গণতন্ত্র মঞ্চ, সমমনা জোট এবং জাতীয়তাবাদী ১২ দলীয় জোটের মূল্যায়ন বিএনপির অনুরূপ। তবে বিএনপির চেয়ে তারা সরকারের সমালোচনা বেশি করে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে বিএনপি যেসব নেতিবাচক কথা বলতে চায় না, সেগুলো এসব জোটের নেতাদের দিয়ে বলায়।
বিএনপির মতো জামায়াতও প্রশাসনের পদায়নে খুশি নয়। দলটির নেতাদের ভাষ্য, বিএনপিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রশাসন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর থেকে বের না করায় নাখোশ জামায়াতও। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের মূল্যায়ন, সরকার প্রথম ১০০ দিনে পুরোপুরি সফল নয়, আবার পুরোপুরি ব্যর্থও নয়।
তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘সরকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ১০০ দিনে জনগণের আকাঙ্ক্ষা শতভাগ পূরণ হয়নি। সরকারের যাত্রার শুরুতেই প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা, জুডিশিয়াল ক্যু, দেশি-বিদেশি চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল না। সরকারে যারা আছেন, তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বও ছিল। এতে সময় নষ্ট হয়েছে।’
গোলাম পরওয়ার বলেছেন– জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগে এখনও ফ্যাসিবাদের দোসররা রয়েছে। এমন প্রশাসন নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। প্রশাসনের অসহযোগিতায় সরকার এগোতে পারছে না। কিছু কিছু পদক্ষেপে সরকার ভুলও করেছে। তবে ভালো দিক– তারা ‘সরি’ বলেছে।
সংস্কারের গতিতে সন্তুষ্ট কিনা– প্রশ্নে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, এ কাজে গতি ভালো। নভেম্বরের মধ্যে কমিশনগুলো হয়তো রূপরেখা দিতে পারবে। তবে সার্বিকভাবে ১০০ দিনে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি।
নির্বাচন বিলম্বিত হলেও কি জামায়াত সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রাখবে– প্রশ্নে গোলাম পরওয়ার বলেছেন, বর্তমান যে ব্যবস্থা, তাতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। তবে মনে হয় না, খুব বেশি সময় লাগবে সংস্কারে।
samakal