শেখ রোকন
ভারতের নির্বাচন কমিশন মাসখানেক আগেই অষ্টাদশ লোকসভার দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল। আজ শুক্রবার, প্রথম দফার ১০২টি আসনে ভোটযুদ্ধ। ২৬টি রাজ্য ও ৮টি ইউনিয়ন টেরিটোরির ৯৬ কোটি ৮০ লাখ সম্ভাব্য ভোটার ৭ দফায় ৫৪৩টি আসনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। প্রায় তিন মাসের এই ‘গ্রেটেস্ট শো অন ডেমোক্রেসি’ ৪ জুন ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
কেবল ভৌগোলিক ঘনিষ্ঠতার জন্য নয়; অভিন্ন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের কারণেও বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের লোকসভা নির্বাচন কিংবা সীমান্তবর্তী অন্তত পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা কঠিন। আরেকটি কারণেও লোকসভা নির্বাচন সীমান্তের এ-পাশেও মনোযোগ আকর্ষণ করে: নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ‘বাংলাদেশ কার্ড’ খেলার প্রবণতা। কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে এবারের লোকসভা নির্বাচন ব্যতিক্রম। আগের মতোই সর্বভারতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে যুযুধান বিতর্ক ও বাগাড়ম্বর চলছে; কিন্তু ‘বাংলাদেশ কার্ড’ কানে বাজছে না। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আঞ্চলিক দলগুলোর পাশাপাশি ভারতীয় জনতা পার্টিও (বিজেপি) লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে এই কার্ড খেলায় অভ্যস্ত।
কূটনীতি ও রাজনীতির চশমা যে ভিন্ন– ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের দুই বছর পর ২০১৬ সালে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার কারণে নরেন্দ্র মোদি নিজে সরাসরি বলেননি, কিন্তু বিজেপির প্রথম সারির নেতারা ফের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বহিষ্কার ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে থাকতেন বিজেপির তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত অনিলচন্দ্র শাহ। লোকসভা কিংবা বিধানসভা নির্বাচন এলেই তিনি ‘বাংলাদেশ কার্ড’ খেলতে পছন্দ করতেন।
যেমন ২০১৫ সালে ডিব্রুগড় গিয়ে বলেছিলেন, আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও মুসলিম সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক দল এআইইউডিএফ মিলে রাজ্যটির একটি অংশ ‘বাংলাদেশ বানাতে চায়’। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণাকালে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশিদের খুঁজে খুঁজে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারণায় বলেছিলেন, রাজ্যটিতে বিজেপি জয়লাভ করলে এমন ব্যবস্থা করা হবে– বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত দিয়ে মানুষ দূরে থাক, পাখিও প্রবেশ করতে পারবে না।
বিজেপি যে এবার বাংলাদেশ কার্ড খেলছে না, সেটা খোদ অমিত শাহকে দিয়েই বোঝা যায়। গত বছর মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোলে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কয়েকটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতে বন্ধন অনেক গভীর। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার ও জীবনযাত্রা হাজার বছর ধরে মিলেমিশে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এই বন্ধন কেউ ছিন্ন করতে পারবে না।’ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৯ মে ২০২৩)।
বস্তুত ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনেই ‘বাংলাদেশ কার্ড’ খেলার গুণগত পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। সেবার বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে এই ইস্যুতে সরাসরি বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়নি। অবশ্য সেবার জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) বাস্তবায়নের বিষয়টি সামনে এনেছিল ক্ষমতাসীন দল। নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপি বলেছিল, এনআরসি প্রক্রিয়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উত্তর-পূর্ব ভারতে এগিয়ে নেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য অংশেও বাস্তবায়িত হবে।
প্রসঙ্গত, আসাম বা পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশকেই তারা ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ এটা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত– ওইসব বাঙালি বা বাংলাভাষী দেশভাগের অনেক আগে থেকেই আসাম বা পশ্চিমবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অধিবাসী। এবারের লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে বিষয়টি আরেকবার প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন সিপিআইএম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে কলকাতাভিত্তিক আনন্দবাজার পত্রিকার ‘দিল্লিবাড়ির লড়াই’ শীর্ষক ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্বে অতিথি ছিলেন মহম্মদ সেলিম। প্রশ্ন করা হয়েছিল- সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ফলে কোন কোন দলের কী কী সুবিধা বা অসুবিধা হতে পারে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা বাঙালি মুসলমানকে টার্গেট করে– পার্লামেন্টে আমি বলেছিলাম। এটা কেবল বাংলার জন্য নয়। গোটা দেশে যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলবে, লুঙ্গি পরবে, দাড়ি আছে, মসজিদে যায়, তাকে বলবে– বাংলাদেশি।’ (আনন্দবাজার অনলাইন, ২ এপ্রিল ২০২৪)।
বস্তুত এবার লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন বিজেপি যে ৭৬ পৃষ্ঠার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে, সেখানেও রয়েছে এই সিএএ। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা সিএএ কার্যকরের ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি এবং যোগ্য ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য এর বাস্তবায়ন হবে।’ এই আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভারতে গেলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারেই রয়েছে– ভারত-চীন, ভারত-পাকিস্তান, ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে ‘শক্তিশালী অবকাঠামো’ গড়ে তোলা হবে। লক্ষণীয়, এখানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কথা নেই। হতে পারে, এই সীমান্তে ইতোমধ্যে কাঁটাতারসহ যথেষ্ট ‘শক্তিশালী অবকাঠামো’ নির্মাণের পর আর কঠোর হওয়ার সুযোগই নেই। আবার এটাও হতে পারে, ইশতেহারের এই প্রতিশ্রুতি ‘বাংলাদেশ কার্ড’ না খেলার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের নির্বাচনে এবার ‘বাংলাদেশ কার্ড’ নেই কেন? সীমান্তের এ-পাশ থেকে ইতিবাচকভাবে দেখলে, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ঢাকার সুদৃঢ় ও ধারাবাহিক অবস্থান বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলেও নতুন উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। চীন যখন প্রধান প্রতিপক্ষ; পাকিস্তান যখন চিরবৈরী; শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ যখন বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে; নেপাল ও ভুটান যখন দোদুল্যমান; তখন বাংলাদেশই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী। সবেধন এই প্রতিবেশীকেও ভারত চটাতে চায় না।
সীমান্তের অপর পাশের তথা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বিজেপির নিজস্ব হিসাবনিকাশও থাকতে পারে। প্রথমত, বিজেপি রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘হিন্দুত্ববাদী’ তকমা ঝেড়ে ফেলে ‘জাতীয়তাবাদী’ পরিচয় বিনির্মাণ করতে চাইতে পারে। যে কারণে ইশতেহার ও প্রচারণার কেন্দ্রে রয়েছে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত ভারত নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। দ্বিতীয়ত, বিজেপি চাইতে পারে নিজেকে ‘বৈশ্বিক খেলোয়াড়’ হিসেবে তুলে ধরতে। দলটির নির্বাচনী ইশতেহারেও সেই আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট। যে কারণে কেবল বাংলাদেশ নয়; এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় পাকিস্তান প্রসঙ্গও খুব একটা উচ্চারিত হচ্ছে না। তৃতীয়ত, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পদচিহ্ন প্রায় শূন্য ছিল। ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী’ ইস্যু তুলে হিন্দু ভোটারদের আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। এখন যখন আসামে ক্ষমতায় এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল; তখন আর এই ইস্যুর প্রয়োজন নেই। চতুর্থত, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে স্থান করে নিতে চাইলে উদার হিন্দু ও মুসলিম ভোটেরও একটি অংশ প্রয়োজন হবে। সেই উদ্দেশ্যে আসামে বাঙালিবিরোধী বা পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমবিরোধী বক্তব্য বাদ দিতে গেলে ‘বাংলাদেশ কার্ড’ খেলার জায়গা আর থাকে কোথায়!
এসব কারণেই সম্ভবত বহুল ব্যবহারে ভোঁতা ‘বাংলাদেশ কার্ড’ এবার সম্ভবত তুলে বা নামিয়ে রাখা হয়েছে।
samakal