অনলাইন ডেস্ক
৯ অক্টোবর ২০২২, রবিবার
নুরুল আফসার হাওলাদার (৪০)। একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বিপণন কর্মকর্তা। গত ২২শে সেপ্টেম্বর রাজধানী উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে র্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকের একটি টিম তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর কেটে যায় দীর্ঘ ১৭ দিন। কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্বীকার করেনি তাকে গ্রেপ্তারের কথা। শনিবার রাতে নুরুল আফসারের সন্ধান মিলে কক্সবাজার থানায়।
নুরুলের ভাগিনা লাবলু জানান, শনিবার (৮ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে মামার নম্বর থেকে বাড়ীকে ফোন যায়। কল রিসিভ করলে জানান তিনি কক্সবাজার সদর থানায় আছেন। পরিবারের সদস্যদের সেখানে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
তিনি জানান, আজ রোববার (৯ অক্টোবর) ভোরে আমরা থানায় এসেছি। ১৮ দিনের মাথায় মামাকে দেখতে পেলাম।
এদিকে নুরুলের অফিসের গ্যারেজে থাকা ৪টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, সাদা পোশাকে প্রায় ১০ জনের একটি দল তাকে নিয়ে যায়। নুরুল যে অফিসে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল খান নিশ্চিত করেন যে, সিসিটিভি ফুটেজগুলো ওই অফিসেরই।
ফুটেজে দেখা গেছে, ওই ১০ জনের দলে একজন তুলনামূলক বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন, যার চুল ও দাড়ি কাঁচাপাকা এবং তার পরনে ছিল সবুজ রংয়ের শার্ট। ওই ব্যক্তিরা ক্লায়েন্ট সেজে তাদের অফিসে যান। ওই ব্যক্তি তার নাম প্রকাশ করেননি। শুধু আমাদের বলেছেন, মিরপুরের রিয়েল এস্টেটে তার আগ্রহ আছে। অফিসেই আমরা কথা বলছিলাম এবং তখন তিনি নুরুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি “নুরুল আফসার” কি না। নুরুল যখন ইতিবাচক উত্তর দেন, তখন ওই ব্যক্তি জানান, তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং বাঁশখালীতে নুরুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। তিনি নুরুলকে গ্রেফতার করতে এখানে এসেছেন। তবে, ওই ব্যক্তি কোনো পরিচয়পত্র দেখাননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো পোলো শার্ট পরা ও ‘র্যাব’ লিখা আইডি কার্ড ঝোলানো অন্য একজন ব্যক্তি আমার অফিসে প্রবেশ করেন।
একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, দুপুর ২টা ৪৮ মিনিটে ওই ব্যক্তি অফিসে প্রবেশ করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন। তার মুখে ছোট দাড়ি এবং চুল সামান্য লম্বা। পরনে ছিল কালো প্যান্ট। ধূসর রঙের পোলো শার্ট পরা আরেকজন ব্যক্তি সিঁড়ির নিচে পাহারা দিচ্ছিল এবং অন্যরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে ধূসর রঙের পোলো শার্ট পরা আরও একজন ছিলেন। ফুটেজ অনুযায়ী, তাদের আগে ধূসর, নীল ও কালো চেকযুক্ত শার্ট পরা আরও ৩ জন ব্যক্তি ছিলেন।
গেটের দিকে মুখ করে থাকা অন্য একটি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, দুপুর ২টা ৪৭ মিনিটের দিকে ৬ জন ব্যক্তি কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেন।
নুরুলকে দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে অফিস থেকে বের করে আনা হয় এবং তখন ধূসর রঙের পোলো শার্ট পরা ব্যক্তিরা তাকে ঘিরে ধরে। তখন কালো শার্ট পরা ওই ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করে।
ফুটেজে কালো পোলো শার্ট ও হালকা নীল রংয়ের জিনস পরা আরও এক দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তিকে দেখা যায়।
নুরুলকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দুপুর ২টা ৫৬ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, যিনি প্রথমে নিজেকে ক্লায়েন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে নুরুলকে শনাক্ত করেন, তিনি খায়রুলের সঙ্গে বেরোচ্ছেন এবং তারেক নামে রিয়েল এস্টেট অফিসের আরও একজন তাদের সঙ্গেই ছিলেন।
লোকটি খায়রুল ও তারেকের সঙ্গে করমর্দন করে এবং এরপর পুরো দলটি নুরুলকে নিয়ে একটি ধূসর মাইক্রোবাস ও একটি কালো পাজেরোতে করে চলে যায়।
খায়রুল খান বলেন, ‘চলে যাওয়ার সময় তিনি (কালো রংয়ের পোশাক পরা লোকটি) বলেছিলেন, আমরা বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, নুরুলকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন তিনি আমাদের আদালতে গিয়ে জানতে বলেন।’
এরপর থেকেই নুরুলের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খায়রুল জানান, একই দিন রাত ৮টার দিকে র্যাব-১ এর সদস্য বলে দাবি করা অপর একটি দল ওই কার্যালয়ে যান। তারা সব ফুটেজ ও সংশ্লিষ্ট ডিভাইস সংগ্রহ করতে ওই অফিসে যান। তারা আইডি কার্ড দেখিয়েছে। কিন্তু আমাদের নাম পড়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়নি। একটি কার্ডে ‘র্যাব’” লেখা ছিল দেখেছি। পরে ফিরিয়ে দেয়া হবে বলে তারা আমাদের অফিসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সব সরঞ্জাম নিয়ে নেয়। তবে, এখনো আমরা সেগুলো পাইনি’।
নুরুলের ভাগিনা লাবলু জানান, প্রায় দেড় বছর আগে বাংলাদেশে ফেরার আগে নুরুল ৭ বছর মালয়েশিয়ায় ছিলেন। নুরুলের পরিবার সাতক্ষীরার আশাশুনিতে বসবাস করে এবং তিনি এখনো অবিবাহিত।
পরিবার জানায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর তারা এ ঘটনায় মামলা দায়ের করতে রাজধানীর তুরাগ যান। কিন্তু থানার ডিউটি অফিসার তাদের বলেন, যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে নুরুলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই তারা মামলা নিতে পারবেন না। ডিউটি অফিসার আরও জানান, নুরুলকে নিশ্চয়ই কোনো তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তদন্ত শেষ হলেই তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, তার জানামতে ‘নুরুল আফসার’ নামে কোনো ব্যক্তিকে র্যাবের হেফাজতে নেয়া হয়নি।