Site icon The Bangladesh Chronicle

বিজেপির কর্মসূচি এবং স্বাধীনতার স্থপতিদের স্বপ্ন কি সাংঘর্ষিক?


শশী থারুর ভারতীয় লোকসভার একজন সদস্য। তিনি কেরালা রাজ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। ড. মনমোহন সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার ক্যাবিনেটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। এর আগে তিনি জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল পদেও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত কংগ্রেসের একজন প্রভাবশালী সদস্য। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লিখেন। ইদানীং তিনি `Modi’s Anti-Muslim Jihad’ নামে একটি কলাম লিখেছেন যা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ইত্যাদি জায়গায় সম্প্রতি সংঘটিত দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে জন্য এর বঙ্গানুবাদ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন মনে করেছি, তাই আমি এর বঙ্গানুবাদ করলাম’‘পাকিস্তান কর্তৃক টি-টেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে ভারত পরাজিত হওয়ার পর ভারতীয় ক্রিকেট বোলার মোহাম্মদ শামি সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষপূর্ণ এবং দানবসুলভ আচরণের সম্মুখীন হয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনকালে এবং নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে এ ঘটনা হলো যা ইসলাম সংক্রান্ত নিন্দারযোগ্য সর্বশেষ একটি গোঁড়ামি।’

এতে কোনো সন্দেহ নেই, ভারতীয় টিমের মুসলিম খেলোয়াড় শামি খেলায় ভালো করতে পারেননি। কিন্তু ভারতীয় টিমের অন্তত আরো ১০ জন খেলোয়াড় সন্দেহজনকভাবে খেলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, অথচ এ ব্যাপারে তাদের নাম ও উচ্চারণ করা হচ্ছে না। এতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়’ শামি মুসলমান ধর্মাবলম্বী বলেই তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন; কেননা পাকিস্তানের খেলোয়াড়রাও মুসলমান। শুনতে খারাপ লাগলেও ওই ঘটনার ফলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ইসলামবিদ্বেষ চলছে। তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আসামের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দারাং জেলা থেকে বহু মুসলমানকে বাড়ি-ভিটা থেকে উচ্ছেদ করেছে এই অভিযোগে যে, তারা সরকারি জায়গার ওপর গৃহনির্মাণ করেছে। উচ্ছেদকৃতরা প্রতিবাদ করলে পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনার ফটো সংরক্ষিত রয়েছে।

সামাজিক মিডিয়াতে অহরহ হত্যার মানসে আক্রমণ ভাইরাল হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এতে বিজেপির ইন্ধন রয়েছে যার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ইদানীং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে অহরহ র‌্যালি বের হচ্ছে। এই সব র‌্যালি প্রায় সময় ভয়াবহ হিংস্রতার রূপ নিচ্ছে। এসবের নেতৃত্ব কোনো প্রকার লুকোচুরি ছাড়াই বিজেপি দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিজেপি নেতৃত্বে মুসলিমবিরোধী যেসব র‌্যালি বের হচ্ছে তা প্রায় জঙ্গি রূপ নিচ্ছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নয়াদিল্লিতে বিজেপির সৃষ্ট হাঙ্গামার ফলে প্রায় ৫৩ জন মুসলমান হত্যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন।

গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। কারণ হিন্দু ধর্মে গরুকে ধর্মীয়ভাবে পূত ও পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। ইতোমধ্যেই ভারতের প্রায় সব রাজ্যে গরুর পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে, গরু নিধনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। পুলিশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আমজনতা আদালতের রায়ের চেয়েও কঠোরভাবে এটা কার্যে পরিণত করে চলছে।

ক্রিকেটারদের পক্ষে উৎসাহজনক ¯স্লোগান দেয়ার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহী আইনে ইতোমধ্যেই পুলিশ ভারতীয় মুসলিম ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সিদ্দিক কাপন নামে এক মুসলিম সাংবাদিককে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসের দায়ে জেলে পাঠিয়েছে, যদিও তিনি সাংবাদিক হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের বেশি কিছুই করেননি।

এ দিকে প্রবীণ রাজনৈতিক নেতারাও তাদের রাজনৈতিক গোঁড়ামি প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক সময় বলেছিলেন, সরকারবিরোধীদের তাদের পোশাক দিয়েই শনাক্ত করা যায়। তাদের পোশাক হবে ঐতিহ্যগত মুসলমান পোশাক। দলের সভাপতি অমিত শাহ বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় মুসলমানদের ‘উইপোকা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আরো বলেছিলেন, বিজেপি সরকার তাদের প্রত্যেককে বঙ্গোপসাগরের নিক্ষেপ করবে। অথচ ভারতের আগের সরকারগুলো সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সব নাগরিকের মধ্যে ভারতে একটি সুমধুর ঐক্য গড়ে তুলতে প্রয়াস চালিয়েছিল। ভারতীয় বহুত্ববাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তখনকার সরকারগুলো আপন প্রয়াস চালিয়েছে।

ভারতের আগের সরকারগুলো ভারতীয় বহুত্ববাদকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর মানসে, এমনকি কর সুবিধা পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করেনি। তারা মনে করত, ভারতের জন্য এই পথের এবং মতের কোনো বিকল্প নেই। এর বাইরে ভারত যে পথেই যাক না কেন, ভারতে কোনো অবস্থাতেই শান্তি এবং ঐক্য কায়েম করা সম্ভব হবে না।

অথচ বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষের ভালোবাসার বিরুদ্ধে পর্যন্ত যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম পুরুষের হিন্দু নারীর প্রতি ভালোবাসাকে বিজেপি ‘খড়াব ঔরযধফ’ বলে আখ্যায়িত করতে আরম্ভ করেছে। তাদের ধারণা, হিন্দু নারীর প্রতি এই ভালোবাসা কোনো ভালোবাসা নয়। বরং এটি ধর্মান্তর করার প্রয়াস মাত্র। অথচ ভারতে শাসনতন্ত্র অনুসারে ধর্মান্তর শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ নয়। বরং ভারতীয় শাসনতন্ত্র এটি নারীদের গণ অধিকার হিসেবে গণ্য করে। কোভিড-১৯-এর কারণে ভারতে বহু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অথচ হিন্দু কুম্ভমেলা অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া দূরে থাক, মেলা সফল করার জন্য সরকার সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি।

ইতোমধ্যেই বিজেপি সরকার একটি নতুন আইন অনুমোদন করেছে যাতে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ থেকে অমুসলিম নাগরিক ভারতে প্রবেশ করলে তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। অর্থাৎ ওই সব দেশ থেকে ভারতে মুসলিম আসা একেবারে নিষিদ্ধ। এই নতুন পদক্ষেপের কারণ হলো’ ভারতে হিন্দু নাগরিকদের জন্মহার কম হওয়ার কারণে একটি সমাধান দেয়া।

ভারতে মুসলমানদের জন্মহার বেশি হলেও বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা ৮০ শতাংশ হলো হিন্দু। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো’ ভারতে স্বাধীনতার পর গঠিত সরকারগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তাতে সারা বিশ্বে একটি সম্মানজনক মানবতাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত তা আজ বিলীন হওয়ার পথে। ভারতের স্বাধীনতার স্থপতিরা সে দেশের শাসনতন্ত্রকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে সারা বিশ্বের কাছে যেভাবে মানব মূল্যবোধের রশ্মি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয়’ বিজেপি মাত্র সাত বছরের শাসনকালীন সময়ে সব মূল্যবোধ প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

একটি সময় ছিল যখন ভারত সরকারের বড় বড় কর্মকর্তারা মুসলমানদের সরকারের সম্মানজনক পদে পদায়ন করতে পারলে আনন্দিত হতেন এই বলে যে, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মুসলমান নিধনের অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বড় বড় পদে মুসলমানশূন্য হয়ে পড়েছে। কারাগারেই মুসলমানদের সবচাইতে বেশি স্থান হচ্ছে। উত্তর ভারতে ইতোমধ্যেই ইসলাম এবং মুসলমানবিদ্বেষ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তবে দক্ষিণ ভারত এখনো অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের সংবাদমাধ্যমের শত শত বছরের গৌরবময় স্বাধীনতার সূর্য ক্রমেই ডুবতে চলেছে।

বিজেপির নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলমানদের ভারতের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নকরণ আরম্ভ হয়েছে। ভারতীয় সমাজকে সুকৌশলে ‘তোমরা’ ও ‘আমরা’তে ভাগ করে ফেলা দ্রুত আরম্ভ হয়েছে। কোনো মুসলমান সঠিক বক্তব্য রাখতে গেলে তাকে পাকিস্তান চলে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। যদি কোনো হিন্দুও এই অমানবিক বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, তাকেও জাতীয়তাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে ভারতের লোকসভায় আমার এক বন্ধু যা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। তা হলো’ ‘বিজেপির শাসনকালে ভারতে মুসলমানদের চেয়ে গরুর জন্য বেশি নিরাপদ’ হবে।

Exit mobile version