Site icon The Bangladesh Chronicle

আজ হতে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ও মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদের নেতৃত্বে ঢাকায় আয়োজিত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের এক সমাবেশ

From Facebook – Mesbah Ul Haq
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের আনুগত্য প্রকাশের পঞ্চাশ বছর
এদেশের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের অফিসার ও সৈনিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ইতিহাসের অংশ। তবে আজ হতে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ও মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদের নেতৃত্বে ঢাকায় আয়োজিত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের এক সমাবেশ হতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য প্রকাশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওই দিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি অফিসারদের এক জমায়েতে এই আনুগত্য প্রকাশ করা হয় যার মূখ্য আয়োজক ছিলেন কর্নেল ওসমানী এবং তাকে ঘনিষ্ঠ সহায়তা প্রদান করেন জেনারেল মজিদ। এরপর অংশগ্রহণকারী অফিসাররা ওই সমাবেশ হতে মিছিল করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যান এবং সেখানে তারা শপথগ্রহণ করেন। শপথগ্রহনের পর কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ওই দু’জন অগ্রণী অফিসার তাদের আনুগত্যের বার্তা ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দেন। মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলির কয়েকটি উজ্জ্বল দিনের মধ্যে অন্যতম ছিলো এই আনুষ্ঠানিক আনুগত্য প্রকাশের ঘটনা।
আসলে ১৯৫০ দশকের শুরুতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসার ছিলেন ১৯২৪ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ যিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলিম জেনারেল। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের বৃটিশ সেনাপ্রধানের বিদায়ের সময় সেই পদে সর্বপ্রথম স্থানীয় অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। উল্লেখ্য তখন চুড়ান্ত মনোনীত তিনজন অফিসারের অন্যতম ছিলেন জেনারেল মজিদ। কিন্তু সেনাপ্রধানের পদের জন্য মনোনীত প্রার্থীর সেই তালিকা উপেক্ষা করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সম্মতিক্রমে প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার আলি মির্জা তালিকা-বহির্ভূত অপেক্ষাকৃত জুনিয়র এক অফিসারকে বেছে নেন – তিনি জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খান, সিনিয়রিটি তালিকায় যার অবস্থান ছিলো দশম। উল্লেখ্য এই নিয়োগে তৎকালীন বাঙালি গভর্নর-জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিনও সম্মতি প্রদান করেন। জেনারেল মজিদ এই ঘোর অনিয়মের তীব্র প্রতিবাদ করেন। অবশ্য এজন্য তাকে পরবর্তীতে খেসারত দিতে হয়। হেনস্তা করতে বহুলালোচিত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয় কিন্তু সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় পরবর্তীতে তিনি ছাড়া পান।
উল্লেখ্য সে’সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আরেক উল্লেখযোগ্য অফিসার ছিলেন কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। ১৯৪২ সালে তিনি ছিলেন ভারতে বৃটিশ সেনাবাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ মেজর। দেশভাগের সময় নবগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৬১ সালে তিনি কর্নেল হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীতে তিনি একজন সুশৃঙ্খল, সাহসী ও ন্যায়নিষ্ঠ অফিসার হিসেবে খ্যাত ছিলেন। সেনাবাহিনীতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ। অনিয়মের মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুবকে সেনাপ্রধান নিয়োগের তিনি প্রতিবাদ করেন। শুধু তা-ই নয়, কথিত আছে খোদ আইয়ুবের কাছেও তিনি তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছিলেন। ধারণা করা হয় এসব কারণে তার পদোন্নতি বিঘ্নিত ও বাধাগ্রস্ত হয়। কর্নেল ওসমানী ১৯৬৭ সালে অবসরগ্রহণ করেন।
কর্নেল ওসমানী দীর্ঘকাল যাবৎ ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মুক্তিকামী আন্দোলনের সমর্থনে তিনি বাঙালি অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের সংগঠিত করেন। এই কাজে তখন তার অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৬৮ বছর বয়স্ক জেনারেল মজিদ গ্রেফতার হন এবং তখন তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হলে তিনি কারামুক্ত হন। স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু তাকে যাথাযোগ্য অবস্থানে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তিনি সে অনুরোধ রাখতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। আর ওদিকে ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করে। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রবাসী সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানী বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে বিশ্বসভায় পরিচিতি পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৮৪ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।
[ছবিঃ
(১) মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
(২) মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ।
(৩) ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধপরবর্তী লাহোরের নিকটবর্তী একটি স্থানে অশ্বারোহী কর্নেল ওসমানী।
(৪) একান্ত আলাপচারিতায় কর্নেল ওসমানি ও জেনারেল মজিদ, কাল অজানা।
(৫) ২২ মার্চ ১৯৭১ বায়তুল মোকাররম হতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের মিছিলের পুরোভাগে কর্নেল ওসমানি ও তার পাশে জেনারেল মজিদ।
(৬) ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর সাথে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী]
Exit mobile version