শেখ হাসিনার এক দশকের শাসনামলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ২,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে বিচারবর্হিভূত হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্র্যাড এডামস September 10, 2020
৩১ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশ এমন কিছু করে বসে, যেটিকে তারা নিয়মিত কাজ বলেই ভেবেছিল। তারা ঠাণ্ডা মাথায় একজন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। তবে এবার তাদের টার্গেট কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা সন্দেহভাজন মাদক কারবারি ছিলেন না; ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, যিনি একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি নিরাপত্তা দলের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর হাতে হত্যার শিকার হাজারও মানুষের মতো মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ভিকটিমে পরিণত হন।
হত্যাকাণ্ডটি এতই ভয়াবহ ছিল যে এর ফলে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আর হাসিনাও তার এক প্রতিশ্রুতির মুখোমুখি হতে বাধ্য হন, যা তিনি অনেক আগেই ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে “জিরো টলারেন্স” থাকবে।
২০০৮ সালে লন্ডনে আমি যখন নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোনের বাসায় দেখা করেছিলাম, তখন তিনি তার দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, যদি তিনি পরবর্তী নির্বাচনে জিততে পারেন, তাহলে এই চর্চা (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) বন্ধ করবেন। তিনি তীব্রভাবে এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড হতে দেব না।”
এমন প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও শেখ হাসিনার এক দশকের শাসনামলে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ২,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। যত হাস্যকরই শোনাক না কেন, সরকারি কর্মকর্তারা গৎবাঁধা বক্তব্যের মাধ্যমে অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেন। তারা বলেন, হত্যার শিকার ব্যক্তিটি মাদক ব্যবসা করছিল বা সহিংস অপরাধী ছিল। একের পর এক মানুষ নিহত হয়, যাকে শ্রুতিমধুরভাবে বলা হয় “ক্রসফায়ার”। আসলে এগুলো হলো সাজানো বন্দুকযুদ্ধ, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো আত্মরক্ষায় পাল্টা আক্রমণ চালানোর ভান করে।
এই “ক্রসফায়ার” শব্দটি এত বেশি ব্যবহৃত হয়েছে যে, এটি এখন সরকারি কর্তৃপক্ষের হত্যাকাণ্ডকে বোঝাতে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজনসহ কিছূ আইনপ্রণেতা প্রকাশ্যে সন্দেভাজন অপরাধীদের “ক্রসফায়ারে” দেয়ার দাবি জানান।
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরও পুলিশ তাদের চিরচেনা গৎবাধা বক্তব্য থেকে সরে আসতে পারেনি। তাদের বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম যে, সিনহার গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়, তখন সিনহা পুলিশের দিকে বন্দুক তাক করেন, আর পুলিশ আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই মিথ্যার বেসাতি খুব দ্রুতই ধরা পড়ে। কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয়। এখন পর্যন্ত ২১ জন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে। এমনকি সরকার গণশুনানিরও আয়োজন করে। সেখানে ভিড়জমা মানুষ অধীর আগ্রহে জানতে চায়, এবার কি তাহলে ন্যায়বিচার হবে?
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদকে তদন্তে সহ-প্রধান হিসেবে যুক্ত করায় তদন্তের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে আইজিপি হওয়ার আগে বেনজির কয়েক বছর ধরে কুখ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) দায়িত্বে ছিলেন। র্যাব হলো একটি আধাসামরিক বাহিনী, যেখানে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা কাজ করেন। বেনজির আহমেদের আমলেই র্যাব কমপক্ষে ৮০টি গুম ও ৪৫০টিরও বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে — শুধু তার আমলেই র্যাব অন্তত ৮০ জনকে গুম ও ৪৫০ জনের বেশি মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে।
২০১৭ সালের এপ্রিলে, বেনজির আহমেদ যখন র্যাবের দায়িত্বে ছিলেন, তখন সুইডিশ রেডিও ওই বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার গোপনে রেকর্ডকৃত বক্তব্য প্রকাশ করে, যেখানে তিনি বলছিলেন, র্যাব নিয়মিতভাবে লোকজনকে উঠিয়ে নেয়, হত্যা করে ও মরদেহ ফেলে দেয়।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা একরামুল হককে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শোনা গিয়েছিল। তার পরিবার ওই কলের অডিও টেপ প্রকাশ করেছিল। তাতে স্পষ্ট একজনকে বলতে শোনা গেছে, “গুলিগুলো নিয়ে যাও।” একজন আরেকজনের কাছে জানতে চাইছিল, “তার হাতের বাধন কি খোলা হয়েছে?” কিন্তু র্যাব দাবি করে যে, একরামুল হক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। যা মূলত হাসিনার রক্তক্ষয়ী “মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে”রই অংশ। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করেছেন বেনজির আহমেদ নিজেই।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দীর্ঘদিন ধরেই র্যাব বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘের নির্যাতন-বিরোধী কমিটি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, র্যাবকে অন্ততপক্ষে পুরোপুরি বেসামরিক বাহিনীতে পরিণত করা হোক।
র্যাব গঠন হওয়ার সময় থেকেই অন্যতম বড় আশঙ্কা ছিল যে, সংস্থাটির মধ্যে সামরিক বাহিনী ও পুলিশের মিশ্রনের ফলে বিভিন্ন সহিংস চর্চা ও কৌশল পুলিশের মধ্যেও চলে যেতে পারে। সেই শঙ্কাই এখন সত্য হয়েছে। বেনজির আহমেদের পদোন্নতির মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, শাসক দলের পক্ষে এসব সহিংসতা দেখভালে যারা সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে পারবে, তারাই পদোন্নতি পাবে, পুরষ্কৃত হবে।
মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত করা একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। “বন্দুকযুদ্ধে” কথিত “মাদক কারবারিদের” হত্যার জন্য তিনি গত বছর সম্মানজনক পুলিশ পদকও পান। অথচ, তিনি গর্বের সঙ্গে “বন্দুকযুদ্ধে” সন্দেহভাজন “মাদক কারবারি” হত্যার কথা বলেছেন।
সিনহা হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ৫ আগস্ট গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর থেকে বাংলাদেশে কিছুদিন “ক্রসফায়ারের” কথা শোনা যায়নি। শেখ হাসিনা, যিনি দীর্ঘদিন নিজেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন বলে দাবি করেছেন, তার উচিৎ এই উপলক্ষকে ব্যবহার করে নিজের মধ্যে সেই মানুষটিকে খুজেঁ বের করার চেষ্টা করা, যিনি ২০০৮ সালে আমার চোখে চোখ রেখে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, অবৈধ হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন বন্ধ হবে। তার উচিত, যাদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে, তাদের অপসারণ করা এবং বিচারবহির্ভূত সকল হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা। তারপরই কেবল তিনি তার জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতি রাখতে শুরু করতে পারবেন।●
ব্র্যাড এডামস, হিউম্যান রাইট ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর।
* এই কলামটি ইংরেজিতে ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।