Minar Rashid
জলাতংক রোগের মতই সত্যাতংক অনরূপ একটি রোগ । জলাতংক রোগীরা জল দেখলেই যেমন অাতংকে কেঁপে উঠে ,তেমনিভাবে কোথাও সত্যের উন্মোচন বা লক্ষণ স্পষ্ট হলেই এই রোগীরা একই ভাবে চমকে উঠে ।
বিশেষ চেতনার প্রলেপ ও সংস্কৃতির সুষমা দিয়ে এরা অনেক সত্যকে ঢেকে ফেলেছে । এখন সেই ঢাকনাটি সরে পড়ার ভয়ে মহা আতংকে পড়ে গেছে।
১৯৭১ সালে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার মন্তব্য নিয়ে এই সত্যাতংকি রোগীরা ইতোমধ্যে মহা হট্টগোল পাকিয়ে ফেলেছে। অন্যান্য মন্তব্যকারী বা গবেষকদের মত বেগম জিয়া ত্রিশ লাখ শহীদের বিপরীতে কোন সংখ্যা উল্লেখ করেন নি। তিনি একাত্তরের গণহত্যাকেও অস্বীকার করেন নি। শুধু সেই সংখ্যা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে – যথার্থ কারণে সেই দুঃখজনক বিতর্কের অবসান কামনা করেছেন। সম্ভবত তিনি একটি সঠিক তালিকা তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছেন। সত্যাতংকি রোগীরা এতেই প্রমাদ গুণেছেন।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমদ শহীদদের এই সংখ্যাটিকে উল্লেখ করেছিলেন ‘দশ লাখ’ বলে। কিন্তু এই যুদ্ধের পুরো নয় মাস যুদ্ধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকা জনাব শেখ মুজিব দেশে এসে ঘোষণা করলেন – ত্রিশ লাখ।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইয়ের নাত্নী শর্মিলা বসু তার গবেষণা থেকে এই সংখ্যাটিকে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ হবে বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল উল্লেখ করেছে এই সংখ্যাটি হবে ২,৬৯,০০০। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এই সংখ্যাটিকে আড়াই লাখ থেকে দশ লাখ বলে উল্লেখ করেছেন।
কাজেই বেগম জিয়া এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে বলে কোথায় ভুল বা অন্যায় করেছেন তা বোধগম্য হচ্ছে না।
এই সত্যাতংক রোগীদের দুয়েক জন সকল হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। জাফর ইকবালের মত চৌকির তলা সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচিত মোহনগঞ্জের রাজাকারের নাতি এদেশের শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর প্রতি চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ” পাকিস্তানীদের প্রতি তার মমতা আছে। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানীদের সাথে মিলিটারী ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। “
এই খোটাটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন জায়গায় আঘাত করেছে তা বোঝার ক্ষমতা মোহনগঞ্জের এই রাজাকারের নাতির কোনদিন হবে না। আসলে এই ধরনের কথাবার্তার মাধ্যমে চেতনা ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রকৃত চেহারাটিই পরিস্কার করেছেন।
অথচ বেগম খালেদা জিয়া কোনদিন কোন কথায় , কোন আচরণে বা কাজের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি কোনরূপ মমতা প্রদর্শন করেন নি। তিনি কখনই পাকিস্তানের পতাকার রঙে কোন শাড়ী পরিধান করেন নি। কিন্তু প্রতিপক্ষ আমাদের জাতীয় দিবসে অত্যন্ত সন্তুষ্টি সহকারে এই কাজটি করেছেন। তাছাড়া যুদ্ধের দাগটি সতেজ থাকাবস্থায় ১৯৭৪ সালেই ভুট্টোর সাথে ঐতিহাসিক গলাগলি করেও তাদের নেতা পাকিস্তানি বনে যান নি । মাঝখান থেকে বেগম খালেদা জিয়া একটা বাস্তব অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেই পাকিস্তানি হয়ে পড়লেন !
হায়রে সেলুকাস! কি বিচিত্র এই আওয়ামী লীগ ! কি বিচিত্র এর নেতা নেত্রীদের মাইন্ড সেট !
আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতে একটি চিহ্নিত গ্রুপ বা চেতনার ব্রিগেইড রয়েছে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সেবা প্রদান করে যায় ।
আওয়ামী লীগের দরকার পড়িবা মাত্রই এরা তাদের ঘৃণার কামানটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এক ধরনের অন্ধ আক্রোশ এদের গণতান্ত্রিক ধারণা , মানবিক অনুভূতি ও সার্বিক বিচারবোধ বা মননশীলতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ।
ফলে সত্যাতংক নামের এই রোগটি অতি সহজেই এদের মাঝে বিস্তার লাভ করেছে। মৃগী রোগীদের শরীরে যেমন করে কম্পন সৃষ্টি হয়, এই সত্যাতংক রোগীরা প্রায়শই আমাদের পুরো সাংস্কৃতিক ও বিনোদন জগতটিকে তেমন করেই কাঁপিয়ে তুলেন । এদের কম্পনে তখন মনে হয় পুরো দেশটিই যেন কাঁপছে।
আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাকে অবদমনের বড় নমুনা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা। বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়ালপনা এমন হয়ে পড়েছে যে এই নির্দিষ্ট সংখ্যা থেকে যে যত কম বলবে, সে তত বড় রাজাকার বলে গণ্য হবেন । এই আশংকা থেকে দেশের ভেতরে কোন মুক্ত গবেষক এই ব্যাপারে কোনরূপ গবেষণা করতে এগিয়ে আসেন নি। তবে রাজাকার বনে যাওয়ার ভয় থেকে মুক্ত থাকায় ইন্ডিয়ার অনেকেই সাহস করে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদের সেই সব গবেষণাতেও এই সংখ্যাটি ত্রিশ লাখ থেকে অনেক অনেক কম। তাতে কি এরাও রাজাকার বা পাকিস্তানি বনে গেলেন? আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব কোনও সুস্থ্য স্বাভাবিক ও যুক্তিবাদি মানুষের জন্যে এই দলটিকে সমর্থন করা কঠিন করে তুলছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হতে হলে তখনকার জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি বিশ জনে একজন করে শহীদ হতে হয়! বিষয়টি নিয়ে পুরো জাতিকেই এক ধরনের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অবস্থায় আটকে ফেলা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যান্য ব্যবহারিক জায়গা গুলোতে। ফলে দেশে যে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে তা এখনও অনেকে ঠাহর করতে পারছে না।
চৌকির তলা সেক্টরের এই মুক্তিযোদ্ধা শুধু বেগম জিয়াকেই গালি দেন নি ,নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইয়ের নাত্নি শর্মিলা বসুকেও জ্ঞানপাপী বলে অভিহিত করেছেন। তিনি একটি নতুন তথ্য জাতিকে উপহার দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নাকি সব জায়গায় অনুমান করে নির্ধারন করা হয়েছে। কোথাও কোন পরিসংখ্যান করা হয় নি। ব্রাভো, মাই ডিয়ার প্রফেসর!
কোন অনুমান করলেও তা বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। যেমন অাপনি অফিসের কলিগ বা ক্লাসমেইটদের সাথে কোন অাড্ডায় বসে অাছেন। সেখান থেকে দেশের দশ প্রান্ত থেকে দশ জনকে বেছে নেন। একাত্তর সালের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে কম এলাকা বেছে নেন।
তারপর জিজ্ঞেস করুন, কার থানায় কতজন মানুষ একাত্তরের যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। দশ জনের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংখ্যাকে দশ দিয়ে ভাগ করে গড় বের করুন। সেই গড় সংখ্যাকে দেশের মোট থানার সংখ্যা দিয়ে গুণ করুন। অাপনি যে সংখ্যাটি পাবেন এটাই হলো অনুমান করে পাওয়া একটি সংখ্যা। তবে অাপনার পাওয়া এই সংখ্যা থেকে একই পদ্ধতিতে অন্যান্য অারো অনেকের সংখ্যা থেকে খুব একটা ফারাক হবে না।
এখন অাপনাদের প্রাপ্য ফলাফল থেকে বুঝতে চেষ্টা করুন কে অাসল জ্ঞানপাপী, মোহনগঞ্জের রাজাকারের নাতি জাফর ইকবাল নাকি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইয়ের নাত্নি শর্মিলা বসু ?
জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগটি কারা করে দিয়েছে বেগম জিয়া সম্ভত: সেই দিকটির প্রতিই ঈঙ্গিত করেছেন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে এমন একটা বিতর্কের সুযোগ কারা করে দিয়েছে, সেই প্রশ্নটিই তুলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসাবে তার এই প্রশ্ন উথ্থাপন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর দরদ থেকেই এসেছে। দারোগা সাবের করুণা উদ্রেকের জন্যে গুণধর ছেলে যদি বলে, দারোগা সাব, খুনীরা আমার দুই দুটি বাপকে মেরে ফেলেছে। তখন মৃত ব্যক্তির লাশও এই গুণধর পুত্রের জন্যে পারলে মাথা চাপড়াতে থাকবে। সদ্য বিধবা কান্না ভুলে উজবুক ছেলের গালে থাপ্পড় দিয়ে বসবে। কাজেই যারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা বেশি দেখানোকে শহীদদের প্রতি বেশি সম্মান দেখানো মনে করছেন তাদের চিন্তাটিও পুণর্বিন্যাশ করা প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছিল। বারো সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কারা কারা সেই কমিটিতে ছিলেন সেই নামগুলিও অনেকের জানা অাছে। তারা বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে তা অাচমকা বন্ধ করে দেয়া হয়। কেন বন্ধ করে দেয়া হয় সেই কারণটিও খুঁজে বের করা দরকার।
ব্যাপারটি অনেকটা সেই গল্পের মত। শিক্ষক লিখলেন,
” কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে। ” এক নাছোরবান্দা ছাত্র প্রশ্ন করলো, নয়নের জল মধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে কীভাবে কপালে ওঠল, স্যার ? নিজের ভুল স্বীকার না করে পন্ডিত মশায় নিচে
লিখলেন, ঠ্যাং দুটি বাঁধা ছিল গাছেরও ডালে।
কাজেই আমাদের বোধ ও ভাবনার ঠ্যাং দুটি গত পয়তাল্লিশ বছর যাবত গাছের ডালে বেঁধে রেখেছি। যারাই এটি উল্টাতে চেষ্টা করবেন, তারাই সত্যাতংক রোগীদের আক্রমণের মুখোমুখি হবেন।
বেগম খালেদা জিয়াও সেটার ব্যতিক্রম হচ্ছেন না।