Site icon The Bangladesh Chronicle

দুই বাংলার মনের কথা

akashbani

কলকাতায় ‘আকাশবাণী মৈত্রী’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবি : ভারতীয় হাই কমিশন

 

আকাশবাণী, কলকাতা—শুনলেই মনের কোণে জেগে উঠত নতুন আশা। যেন জীবন পেত একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বাঙালিরা। সেই উত্তাল দিনগুলোতে কাঁধে রাইফেল নিয়ে ছুটে চলা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও অনুপ্রেরণার এক বড় উৎস ছিল আকাশবাণী। আর অনুপ্রেরণাদাতাদের একজন ছিলেন কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আকাশবাণীতে খবর পড়তে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করতে পারতেন না। তাঁর নিজেকেই মনে হতো একজন মুক্তিযোদ্ধা। বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ পরিক্রমা বা সংবাদ সমীক্ষা পাঠে। রণাঙ্গনের খবর, মুক্তিবাহিনীর নতুন নতুন সাফল্যের কথা তাঁর কণ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ত বাংলায়।

আকাশবাণী রেডিও কেন্দ্রে ১৯৬৩ সালে চাকরি শুরু করে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নেন ১৯৯৪ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বহু বছর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ অনুষ্ঠান সমপ্রচার হতো আকাশবাণীতে। ২০১০ সালে সেই অনু্ষ্ঠান হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বাঙালি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মনে জাগে নতুন ভাবনা—উভয় দেশের বাংলাভাষীদের মৈত্রী-বন্ধনের বেতার কি আবার চালু করা যায় না! সেই ভাবনা থেকেই ২০১৩ সালে তিনি ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভারত-বাংলাদেশ রেডিও মৈত্রীর বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতের

তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয় নতুন রেডিও ‘আকাশবাণী মৈত্রী’ চালু করার উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ভারত ও বাংলাদেশের বিষয়বস্তু নিয়ে একটি রেডিও চ্যানেল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়।

অবশেষে সেই বেতার চ্যানেলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো গতকাল মঙ্গলবার। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় কলকাতায় রাজভবনে (গভর্নর হাউস) গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় নতুন বহির্দেশীয় বাংলা বেতারকেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত। আকাশবাণীর এটি এক অভিনব প্রয়াস। আকাশবাণী মৈত্রীর এই সূচনার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে। এই প্রয়াস বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।’

ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। দুই দেশের সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য আকাশবাণী মৈত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। আমি নিশ্চিত, আকাশবাণী মৈত্রী আমাদের মন জয় করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা এবং সেই দিনের আকাশবাণীর ভূমিকার কথা আজও মানুষের মনে গ্রথিত হয়ে আছে।’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি, প্রসার ভারতীর প্রধান নির্বাহী (সিইও) জহর সরকার, অল ইন্ডিয়া রেডিওর মহাপরিচালক ফৈয়াজ শাহরিয়াসহ বিশিষ্টজনরা।

জানা গেছে, প্রথম দিকে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা করে সম্প্রচার করা হবে বাংলা অনুষ্ঠানমালা। পরে ২৪ ঘণ্টাই তাজা অনুষ্ঠান সমপ্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আকাশবাণীর বহির্দেশীয় পরিষেবা বিভাগের পরিচালক অম্লান জ্যোতি মজুমদার জানান, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসামসহ বাংলাদেশ লাগোয়া বাংলা ভাষাভাষী রাজ্যগুলোর শ্রোতাদের কথা ভেবেই পুরো অনুষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে। খবর, আলোচনা, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ছাড়াও তথ্যমূলক বেশ কিছু অভিনব অনুষ্ঠান সমপ্রচার করবে আকাশবাণী মৈত্রী। বাংলাদেশের সব শ্রেণির শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি এফএম স্টেশনের সঙ্গেও চুক্তিবন্ধ হবে আকাশবাণী মৈত্রী। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে এরই মধ্যে কয়েকটি এফএম রেডিও স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে বলেও জানান তিনি।

আকাশবাণী কলকাতার বার্তা সম্পাদক ও আকাশবাণী মৈত্রী চ্যানেলের অন্যতম কর্মকর্তা সুস্মিতা মণ্ডলের মতে, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে আকাশবাণী মৈত্রী। সমপ্রচার হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেই সঙ্গে সম্প্রচার হবে খবর। ঢাকার খবর নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান হবে আকাশবাণী মৈত্রীতে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আকাশবাণী মৈত্রী উদ্বোধনকে স্বাগত জানিয়েছেন। আলাদা বার্তায় তাঁরা আশা প্রকাশ করেন, এই নতুন চ্যানেল দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের ‘সেতুবন্ধন’ হয়ে উঠবে।

পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুরায় এই ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে এবং পুরো বাংলাদেশ থেকে এই রেডিও সার্ভিস শোনা যাবে। ভারত ও বাংলাদেশে এই সার্ভিস ৫৯৪ কেএইচজেড বেতারতরঙ্গে সম্প্রচার হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে বোলপুরে শান্তিনিকেতন আকাশবাণী কেন্দ্রে প্রসার ভারতীর সিইও জহর সরকার সাংবাদিকদের জানান, এটা হবে দুই বাংলার চ্যানেল। তিনি বলেন, ‘নতুনভাবে যখন শুরু করব, তখন নতুন ভাবনা কেন নয়? আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের কলকাতায় এনে আকাশবাণী মৈত্রীতে অনুষ্ঠান করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, এটা যদি সম্ভব হয়, তাহলে বিশ্বের ব্রডকাস্টিং ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হবে।

জহর সরকার আরো বলেন, ‘আকাশবাণী শান্তিনিকেতন এ ক্ষেত্রে এক বড় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। দুই বাংলার সংস্কৃতিচর্চায় শান্তিনিকেতন এক বড় যোগসূত্র। বাংলাদেশের বহু শিল্পী এখানে সরাসরি আসেন। তাঁরা এখানেই আকাশবাণী মৈত্রীর জন্য অনুষ্ঠান করতে পারেন, পাশাপাশি শান্তিনিকেতন ঘরানার যেসব অনুষ্ঠান হয়, সেগুলো এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।’

 

Exit mobile version