Site icon The Bangladesh Chronicle

৯ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশে উঠেছে সুদহার : চাপ বাড়ছে ব্যবসায়ী ভোক্তা সবার

ছয় মাস আগেও দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্প গ্রুপের প্রতি মাসে ব্যাংক ঋণের সুদ আসত প্রায় ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু ঋণের সুদহার বাড়ায় গত মাসে গ্রুপটিকে বাড়তি ৩০ কোটি টাকার সুদ গুনতে হয়েছে। সুদ ব্যয়ের পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার ও অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গ্রুপের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। গ্রুপটির বাড়তি ব্যয়ের এ বোঝা এসে চাপছে ভোক্তাদের ঘাড়ে।

দেশের ব্যাংকগুলোয় ভোগ্যপণ্য আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনের সঙ্গে সম্পৃক্ত গ্রুপটির ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেছে। দাম বেশি হওয়ায় মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পণ্য কিনছে। এর প্রভাবে কোম্পানির বিক্রি প্রায় ২৫ শতাংশ পতন হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধির চাপ আর নিতে পারছি না। অনেক ঋণের কিস্তি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন পুনঃতফসিল করে ঋণ নিয়মিত রাখার চেষ্টা করছি।’

উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু ভোগ্যপণ্য নয়, দেশের সব ধরনের ব্যবসায় এখন এ চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। ঋণের সুদহার বাড়ায় ব্যবসার ব্যয় বেড়েছে। বাড়তি এ ব্যয়ের চাপ পড়ছে ব্যবসায়ী-ভোক্তা সবার ওপরই। এতে আরো উসকে উঠছে দেশের বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

দেশের বড়, মাঝারি কিংবা ছোট—সব খাতের ব্যবসায়ীরই বাড়তি সুদ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বাড়ছে ব্যাংক খাতে। ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বাড়তি সুদের চাপে অনেক ভালো গ্রাহকও ঋণের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছেন না। আর ব্যবসায়ীরা জানান, সুদহার বৃদ্ধির চাপ তারা আর নিতে পারছেন না। গ্যাস-বিদ্যুতের বিল দ্বিগুণ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ পরিচালন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খেলাপি ঋণের চাপ আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।

ঋণের সুদ ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঋণের সুদহার ব্যাংক আর গ্রাহকের সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের ব্যয় বাড়লে দিন শেষে এর প্রভাব পণ্য ও ভোক্তার ওপর পড়বে। আমরা এ পরিস্থিতির সমাধান চাই। এ সমাধান নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আসতে হবে। এজন্যই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি। সুদহারের পাশাপাশি ডলারের বিনিয়ম হার নিয়েও আমরা বৈঠকে কথা বলব।’

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে গত ৮ মে ব্যাংক ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও এর আগেই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ঋণের সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ওই সময় ঋণের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে নেয়া হয়। ঋণের সুদহার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। কিছুটা নিয়ন্ত্রিত এ পদ্ধতি চালুর পরও মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে ঋণের সুদহার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর গত এক সপ্তাহে অনেক ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশেও উন্নীত করেছে।

ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি একই দিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে মার্কিন ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা। যদিও ওই দিনের শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ১১০ টাকা নির্ধারিত ছিল। সে হিসাবে একদিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো চাইলে এর চেয়ে বেশি কিংবা কম দামেও ডলার বেচাকেনা করতে পারবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়।

ডলারের বর্তমান ঘোষিত দর আমলে নিয়ে গত দুই বছরের ব্যবধানে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে আনুষ্ঠানিক খাতেই প্রতি ডলার ১১৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। টাকার এ রেকর্ড অবমূল্যায়নের প্রভাবে আমদানিনির্ভর প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ব্যবসার ব্যয়ও।

দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে বৃহত্তম জায়ান্টগুলোর একটি মেঘনা গ্রুপ। সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও এমডি মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত এমন সময়ে নেয়া হলো, যখন অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়ার মুখেই এটি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখন একেক ব্যাংক একেক ধরনের সুদ নিলে সেটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে। আমি বলছি না, সরকার সুদহার নির্ধারণ করে দিক। কিন্তু এটার একটা সীমা থাকা দরকার।’

মোস্তফা কামাল বলেন, ‘সুদহার নয়-ছয় ঠিক করে দেয়া উপযুক্ত কাজ হয়নি, এখন পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার আগে সময়টি কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা আরো পর্যালোচনা করা যেত। এমন পদক্ষেপ নেয়ার আগে প্রেক্ষাপট  বিবেচনা করতে হবে। ডলারের বিনিময় হারের যে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সেটি কি বাস্তবে কার্যকর হয়েছে? এমনিতেই দেশে বিনিয়োগ স্থবির। এ অবস্থায় আমদানিতে আরো বেশি স্থবিরতা দেখা দেবে।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ঋণের সুদহার বাড়ানো হলেও তা অর্জন করা হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ এপ্রিলেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ২৩ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদদের দাবি, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।

বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে ‘নীতি সুদহার’ও কয়েক দফা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত সপ্তাহেও নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও দেশের ব্যাংক খাতে দুই বছর ধরেই তীব্র তারল্য সংকট চলছে। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) একদিন মেয়াদি ধারের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। সুদহার এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও কলমানি বাজারে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ মিলছে না। এজন্য ব্যাংকগুলোকে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার বাড়াতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে। আর মার্চ পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

দেশের বৃহৎ করপোরেটগুলোর একটি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ভোগ্যপণ্য, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিকস, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে গ্রুপটির। ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) উজমা চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কষ্ট হলেও আমাদের মতো বড় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছে। কারণ আমাদের মতো অনেকেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিতে পারছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা নতুন বিনিয়োগ করতে পারছি না। সরবরাহকারীদের সময়মতো পাওনা বুঝিয়ে দিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। কীভাবে আরো ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়ে ব্যবসা করা যায়, এখন সে বিষয়ে মনোযোগী হচ্ছি।’

দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ থাকার পরও গত তিন বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর বাইরে আরো ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার খেলাপি যোগ্য ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। খেলাপি ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ। এ হিসাবে দেশের ব্যাংকগুলোর ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায়। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ এখন দুর্দশাগ্রস্ত।

এ অবস্থায় ঋণের সুদহার বৃদ্ধির চাপে খেলাপি ঋণের হার আরো তীব্র হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের অর্ধডজন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, গ্রাহকরা ঠিকমতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘ছয় মাস আগে যে ব্যবসায়ী ৮ শতাংশ সুদের ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন না, এখন তিনি ১৪-১৫ শতাংশ সুদ কীভাবে পরিশোধ করবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি সুদহার বাড়ানোর বিপক্ষে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হচ্ছি।’

তবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘উচ্চ সুদহারের সময়েই দেশে প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে। ঋণের সুদহার ৮-৯ শতাংশে নেমে আসার পরও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি দেখা যায়নি। দেশের অর্থনীতিকে টেকসই ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে সুদহার ও বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতেই হতো। আমাদের উদ্যোক্তাদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।’

Bonik Barta

Exit mobile version