নিজস্ব প্রতিনিধি
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারে রাজনীতিবিদ নাকি সরকারি আমলারা এগিয়ে এনিয়ে এখন প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় বছরে কত হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছেন তারা। প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম ঝড়ানো আয়ে বৈদেশিক মূদ্রা ও গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের আয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি সচল থাকলেও রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও আমলারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছেন। সম্পদের পাহাড় গড়ছেন ভিন্ন দেশে। বেকায়দায় পড়লে সেখানে গিয়ে তারা আরাম আয়েশে জীবন-যাপন করবেন। স্ত্রী সন্তানদের বিদেশে রাখতেই পছন্দ শীর্ষ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের। তাদের টাকায় কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে উঠার খবরও বের হয়েছে ইতোমধ্যেই।
টাকা পাচারের রাজনীতিকের চেয়ে আমলারা এগিয়ে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের এমন বক্তব্যের পর টাকা পাচার এখন আর ওপেন সিক্রেট নয়। বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের গুঞ্জনের কিছুটা সত্যতা পেয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তালিকায় রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীর চেয়ে সরকারি কর্মকর্তারা টাকা পাচারে এগিয়ে আছেন বলে দাবী করেন মন্ত্রী নিজে। শাসক দলের রাজনীতিক নেতাদের টাকা পাচারকে আড়াল করতেই তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন কি না এনিয়ে এখন গুঞ্জন চলছে। তবে,পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর হাইকোর্ট থেকে এক আদেশে পাচারের তালিকা চাওয়া হয়েছে। দেশের আওয়ামী গণমাধ্যম ও বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা পাচার নিয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছিল এতদিন। এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তালিকা চেয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনায় টাকা পাচারের বিষয়টি এখন পরিস্কার।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কথায় আরেকটি বিষয় স্পষ্ট যে, ভোট চুরি করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আমলা সহ সরকারি কর্মকর্তাদের নানান সুযোগ-সুবিধা দিলেও তারা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেন। মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে মিলেমিশে চুরিচামারি করছেন তারা।
এখানে উল্লেখ্য, গত ২১ আগষ্ট ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামিমকে গ্রেফতার করা হয়। সিআইডি অনুসন্ধানের পর ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করে তার বিরুদ্ধে। এরপরই গ্রেফতার করা হয় তাকে। ছাত্রলীগের একটি জেলার নেতারই পাচারের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা। এর থেকে অনুমান করা যায়, তার চেয়ে বড় নেতারা কতটা এগিয়ে রয়েছেন।
গত ২ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল, প্যারাডাইস গ্রুপের চেয়ারম্যান ২ শত কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন কানাডায়।
পিকে হালদার নামে অপর একজন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন কানাডায়।
টাকা পাচারের বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন এমন একটি বিদেশী সংস্থা হচ্ছে জিএফআই (গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি)। গত মার্চ মাসে এই সংস্থাটির প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী টাকায় এটি সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। যা দেশের চলতি বছরের (২০১৯-২০২০) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। একই প্রতিষ্ঠান এর আগে এক রিপোর্টে বলেছিল ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। তখন বলা হয়েছিল ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা।
টাকা পাচার সংক্রান্ত এক রিপোর্ট প্রকাশের পর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দেশ থেকে প্রতি বছর যে টাকা পাচার হয়, এটি তার আংশিক চিত্র। পুরো চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ মোট বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। দক্ষিণ এশিয়ার এ সংক্রান্ত তালিকায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। জিএফআই এর মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে।
এদিকে কানাডায় ১ হাজার ৫৮২টি মূদ্রা পাচারের তথ্য দেশটির আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে বলে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে খবরের কাগজে উঠে এসেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ক’জন সেটা নিয়ে কৌতুহল রয়েছে অনেকেরই। খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, কানাডায় মূদ্রা পাচারকারী ২০০ বাংলাদেশীর নাম ইতোমধ্যেই দেশটির বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কানাডায় পাচারকারীরা বর্তমান শেখ হাসিনা জামনায়ই দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে।
অথচ বিরোধী দলে থাকতে শেখ হাসিনার মুখেই হরহামেশা তৎকালীন সরকারী দলের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ শোনা যেত।