খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সুদহার বাড়লেও এখনও কিছু ব্যাংকের আমানত প্রবাহে ধীরগতি রয়েছে। কারণ এসব ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা নেই। তাই এখন সুদ বেশি দিলেও আমানত রাখছে না। আবার ঋণ আদায়ে ধীরগতির পাশাপাশি ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে।
তাছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সরাসরি সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে নেয়া সরকারের ৩৫ হাজার ৫১২ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ হয়েছে। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৪৪ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এসবের প্রভাবে ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। তাই রেকর্ড ধার করতে হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর টাকার সংকট মেটাতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলার অদলবদল বা কারেন্সি সোয়াপ চালু করেছে। এ পদ্ধতিতে যেসব ব্যাংকে উদ্বৃত্ত ডলার রয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা নিতে পারবে। এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে ১২টি ব্যাংক ৫৮৮ মিলিয়ন ডলার জমা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার সাত দিন মেয়াদি রেপোর বিপরীতে ২৫টি ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১৬ হাজার ২৭ কোটি টাকা, যার সুদহার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এক দিন মেয়াদি রেপোর বিপরীতে সাতটি ব্যাংক দুই হাজার ৩০ কোটি টাকা নিয়েছে, যার সুদহার ছিল আট শতাংশ। শরিয়াহভিত্তিক চারটি ব্যাংক সাত শতাংশ থেকে আট দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ১৪ দিন মেয়াদি ধার করেছে এক হাজার ৮০ কোটি টাকা। ‘স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি’ হিসেবে দুটি ব্যাংক সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে এক দিনের জন্য নিয়েছে ২৮৯ কোটি টাকা। এক দিন মেয়াদি তারল্য সুবিধার আওতায় ১৩টি ব্যাংকে আট শতাংশ সুদে নিয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। আর ১৮০ দিন মেয়াদি অ্যাসিউরড রেপোর আওতায় দুটি ব্যাংক ৫০৪ কোটি টাকার তারল্য সুবিধা নিয়েছে, যার সুদহার ছিল আট শতাংশ। সর্বমোট ২৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ব্যাংক বড় ধরনের তারল্য সংকটে রয়েছে। ফলে পুরো খাতেই এ সংকট ছড়িয়ে পড়ছে, যার প্রভাবে দেশের ভালো ব্যাংকগুলোও দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক মান যাচাইকারী সংস্থাগুলোর কাছে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে টাকা দেয়া বন্ধ করার পর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিতে হচ্ছে। আবার ডলার বিক্রির বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা উঠে আসছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক মানি সাপ্লাই কমাতে পলিসি রেট বাড়িয়েছে, যার কারণে মার্কেটে তারল্য ঘাটতি তৈরি হবে, সেটাই হচ্ছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার না দিলে সংকট বাড়বে। তাছাড়া একবারে সব দিক দিয়ে সংকোচন করা যায় না, যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ধার দেয়া অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরেও এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে কলমানিসহ বিভিন্ন মেয়াদে ধার করে চলছে। গতকাল বুধবার কলমানিতে নিয়েছে তিন হাজার ছয় কোটি টাকা, যার গড় সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে এক দিন মেয়াদি কলমানিতে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে নিয়েছে দুই হাজার ৫১৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের জুনে গড় কলমানি রেট ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ, জুলাইয়ে তা কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশে দাঁড়ায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূলনীতি সুদহার বা পলিসি রেট বাড়ানোর এক দিন পর অক্টোবরে এই কলমানি রেট বেড়ে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ হয়ে যায়। ডিসেম্বরের শুরুতে কলমানি রেট ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। তবে মুদ্রানীতি ঘোষণা রেপো রেট বাড়ানোর পর কল মানি রেট ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। তবে কিছু ব্যাংক ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বেশি হওয়ায় তাদের নিজেদের ফান্ড সেখানে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করছে। আর কম সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোয় ধার করছে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক ব্যাংক এখন ব্যবসা করছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে রেকর্ড ধার হচ্ছে।
share biz