Site icon The Bangladesh Chronicle

২৪-এর নির্বাচন কি অর্থনীতির সংকট কমাবে না বাড়াবে

ফারুক ওয়াসিফ

নির্বাচন আসলেই আগে শোনা যেত স্লোগান হচ্ছে, ‘সামনে আসছে শুভদিন, অমুক/তমুক মার্কায় ভোট দিন’। নির্বাচন আর শুভ পরিবর্তনের আশা বাংলাদেশিদের রক্তে-মজ্জায় গাঁথা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে শুভদিন আসবে, কারণ তারা ছয় দফার ভিত্তিতে দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্ত করবে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে এরশাদ জমানার পরের জমানার শাসক নির্বাচিত হবে, তারা আগের আমলের দুঃখ-দুর্দশা দূর করে দেবে। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। কিন্তু একমাত্র জাতীয় নির্বাচনের বেলায় তারা ভোট দেয় উল্টা চেতনায় যে, বিগত সরকারের চেয়ে পরের সরকার কিছুটা তো ভালো হবে।

কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচন কি শুভদিন নিয়ে আসবে? আনলে কাদের জন্য আনবে, গোষ্ঠীর জন্য নাকি অধিকাংশ মানুষের জন্য?

এই প্রশ্নের উত্তর শুধু রাজনীতির ঘরে খুঁজলে হবে না, খুঁজতে হবে অর্থনীতির দোকানেও। সোজা কথায়, ২০২৪ সালের নির্বাচন কি অর্থনীতির এই দুরবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দেবে? কিছুটা কি সহনীয় করবে জীবনযাত্রা? ভবিষ্যৎ নিয়ে নিদারুণ অনিশ্চয়তার কি অবসান ঘটবে?

সরকার ‘যে কোনো মূল্যে’ নির্বাচন করে ফেলার জন্য নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করার ব্যবস্থা করেছে। নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে ৭ জানুয়ারি। এই ‘যে কোনো মূল্যে’র মধ্যে কি অর্থনীতির মূল্যটাও ধরা আছে?

বাংলাদেশ গভীর রাজনৈতিক বিভক্তির মধ্যে পড়ে গেছে। এই বিভক্তি আরও জোরালো হয়েছে ভূরাজনৈতিক পরাশক্তিগুলো জড়িত হওয়ার জন্য। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে রিজার্ভ সংকট। রিজার্ভ সংকটে ভোগের পণ্য ও কারখানার কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে অর্থনীতির আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে, উৎপাদন পূর্ণমাত্রায় চলতে পারছে না। কাজে কাজেই সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। মানুষ দুর্দিনের ভয়ে ভীত। মানুষ জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম বাড়াতেও অতিষ্ঠ। এই সার্বিক সংকট থেকে উদ্ধার পেতে চায় মানুষ। ২০২৪ সালের সরকার ঘোষিত নির্বাচনী আয়োজন এবং তার ফল কি অর্থনীতির বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে?

বরং দেখা যাচ্ছে, সরকার যে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়ে নির্বাচন করে ফেলতে চাইছে, তাতে করে অর্থনীতির সংকট আরও মারাত্মক জায়গায় চলে যাবার ঝুঁকি থাকছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সত্য সত্যই বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এ ব্যাপারে তাদের চাওয়াটা আলংকারিক নয়, বাস্তব। তারা বাংলাদেশে পশ্চিমা ধরনের বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চায়। কেবল ওই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তারা কাজ করতে অভ্যস্ত। এখানে চীনা ধরনের বা কম্বোডিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়া ধরনের রাজনীতি ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে তাদের জন্য ভীষণ অসুবিধা হবে। এবং সেসব অসুবিধার বড় একটি জায়গা হলো নিরাপত্তা আয়োজন। পশ্চিমা নিরাপত্তা ছাতার মধ্যে থাকা ছাড়া কোনো দেশকে তারা অর্থনৈতিক অংশীদার সাধারণত করে না। একটা সময়ে মিয়ানমারকে তারা রাজনৈতিক ছাড় দিয়ে অর্থনৈতিক অংশীদার করতে গিয়েছিল। তার ফল বুমেরাং হয়েছে। মিয়ানমার পুরোপুরিই পাশ্চাত্যবিরোধী রাজনৈতিক ব্লকে চলে গেছে।

এরকম একটি বাস্তবতায় যখন বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য পাশ্চাত্য, বাংলাদেশিদের বসবাস, বিনিয়োগ ও টাকা পাচারের গন্তব্যও যখন পশ্চিম, যখন পশ্চিমা বিনিয়োগ আমাদের ভীষণ দরকারও (যেমনটা করে থাকে জাপান), তখন পশ্চিমা মডেলের উল্টা রাজনৈতিক মডেল কি অর্থনীতির জন্য ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে না?

নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের আপত্তিতে কান না দিয়ে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করে ফেলেছে। সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্তহীন সংলাপের ডাকও নাকচ করে দিয়েছে। এই চালচলন অব্যাহত থাকলে সহিংসতা বাড়বে। তাতে জীবনের পাশাপাশি সম্পদ ধ্বংস হবে। ইতোমধ্যে অবরোধে অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে গেছে। এই ধারায় চললে, যে কায়দায় নির্বাচন হবে তাতে দীর্ঘদিনের অশান্তি নেমে আসতে পারে দেশে। সেটার অর্থনৈতিক খেসারত বিপুল। তা ছাড়া আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনের ফল দেশে বা বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কথা না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভিসা নীতির চেয়েও কঠোর পদক্ষেপের জোরালো ঝুঁকি থাকছে। ভিসা নীতিতে জনগণের তেমন কষ্ট হয়নি, কিন্তু আরও বড় পদক্ষেপের খেসারত দিতে হতে পারে জনগণকে। পরের দফায় যদি যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়, এখনকার এই ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির অবস্থা কী হবে?

একটা দেশ কোন দেশের মিত্র হবে বা হবে না, সেটা সে দেশের শাসক দলের মতাদর্শ বা খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে না। সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোর চরিত্র এবং উন্নয়নের স্তরের ওপরেই নির্ভর করে। বাংলাদেশ আধা শিল্পায়িত দেশ। আমাদের পোশাকশিল্পের গন্তব্য পাশ্চাত্য। আমাদের বিনিয়োগ আসে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি এবং জাপানের জাইকা থেকে। চীন আমাদের দেশে সম্প্রতি বড় আকারের ঋণ দিয়ে আসছে। ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং খাদ্য ও পরিবেশগত দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। স্বাভাবিকভাবে এই তিন দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রয়োজন। কিন্তু যদি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের প্রভাবিত দেশ ও প্রতিষ্ঠানের তরফে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসে, সেটা কি আমরা অন্য মিত্রদের মাধ্যমে সামলাতে সক্ষম?

রাতারাতি পোশাকশিল্পের বাজার পশ্চিম থেকে পুবে ঘোরানো অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উন্নত করবার জন্য যে আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতাগুলো দরকার, পশ্চিম তার বড় একটি উৎস। এবং একটি গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার সুফলও কম না।

সুতরাং সব দিক হিসাব করে যদি ২০২৪-এর জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে কি বলা যাবে যে সামনে আসছে শুভদিন? যে নেতৃত্বের হাতে অর্থনীতির এই দুরবস্থা হলো, তাদের হাত দিয়েই কি এর সমাধান হওয়া সম্ভব? সেরকম কোনো রূপরেখা কি কোথাও দেখা গেছে? এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও কি বিগত দিনে অর্থনীতির সমাধানের কোনো দিশা দেখাতে পেরেছে? বরং আমরা দেখছি অর্থনীতি বিযুক্ত রাজনৈতিক আলাপ।

কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হলে অর্থনীতির সংকটের সমাধান হবে না। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বিভিন্নভাবেই হতে পারে। বর্তমান সরকার বিরোধীদের নিশ্চুপ করিয়ে নির্বাচন করিয়ে নিয়ে ক্ষমতাসীন থাকতে পারে। অথবা বিরোধীরা কোনো নতুন বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন হতে পারে। অথবা ২০০৬ সালের মতো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ হতে পারে। যাই-ই হোক, যারাই ক্ষমতায় থাকুন বা আসুন, অর্থনীতিই হবে তাদের প্রধান অগ্নিপরীক্ষা। সুতরাং এই অর্থে রাজনৈতিক সংকট আর অর্থনৈতিক সংকট আসলে একই সংকটের দুটি মাত্রা।
তাই শুধু নির্বাচন করে ফেলাতেই বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের বিজয় আসবে না, বিজয় আসবে কেবল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবার মাধ্যমে। সেটা না পারলে যে কোনো উপায়ে বা যে কোনো মূল্যের নির্বাচন দেশটাকে আরও কষ্টদায়ক ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকটের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এ কারণেই আবারও বিনীতভাবে প্রশ্ন জানাই, ২০২৪-এর নির্বাচন কি সংকটের সমাধান দেবে নাকি তাকে আরও পাকিয়ে তুলবে?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক

সমকাল

Exit mobile version