Site icon The Bangladesh Chronicle

২০ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বাংলাদেশ

গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে টানা ২০ মাস ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জীবনযাপনও কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতিতে তিন দশকে আর কখনই এত দীর্ঘসময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হতে দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্বের কারণেই এটি জেঁকে বসেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের উত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতির বিকাশ শুরু হয়। ওই দশকে কখনো কখনো মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তা খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। এক বছর বাড়লেও পরের বছরই তা কমে গেছে। ওই দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন ছিল ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর পরের দশকের শুরুতে ২০০০-০১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ওই দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এরপর গত দশকে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে ২০১১-১২ অর্থবছরে, যার হার ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ ছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। চলতি দশকের প্রথম দুই অর্থবছর ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৬ ও ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ওই ধারা অব্যাহত আছে এখনো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতির যে প্রবণতা দেখেছি সেটি হচ্ছে এটি বেশ ধীরে ওঠা-নামা করে। মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে বেড়ে গেলে ভোক্তাদের কষ্ট বেশি হয়। আর ধীরে বাড়লে তাদের ওপর চাপ কম পড়ে। অন্যদিকে এ হার হঠাৎ কমে গেলে সরবরাহকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর ধীরে কমলে তাদের জন্য তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি কার্ডধারীকে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ করছে। তাছাড়া ট্রাকের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কম দামে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এ ধরনের কর্মসূচি না থাকলে মূল্যস্ফীতি আরো বেশি হতো। সরকারের কৃতিত্ব হলো মূল্যস্ফীতি বল্গাহীন নয়। এর বল্গাটাকে ধরে রাখা গেছে। বর্তমানে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। আশা করছি এটি ধীরে ধীরে কমে আসবে।’

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসের পুরো সময়ে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, আগস্টে ৯ দশমিক ৯২, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬৩, অক্টোবরে ৯ দশমিক ৯৩, নভেম্বরে ৯ দশমিক ৪৯, ডিসেম্বরে ৯ দশমিক ৪১, জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ৮৬ এবং সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ ছিল। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যপণ্যে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। গত বছরের অক্টোবরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে উঠে গিয়েছিল।

সাবেক অর্থ সচিব এবং মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা ও বাজার শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে গেছে। এ কারণে অনেক সময় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, যার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তাছাড়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থাকা সত্ত্বেও ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এসএলআর হিসেবে এ বন্ড ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতে তারল্যের জোগান বাড়বে। এটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতে যাচ্ছে। এতে মুদ্রানীতি সঠিকভাবে কাজ করবে না। আরেকটি দিক হচ্ছে আগে বাজারে ডলার সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা উঠিয়ে নিত। কিন্তু বর্তমানে এটা কিছুটা শর্তযুক্ত। ব্যাংককে টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার নিচ্ছে। এতেও তারল্য সরবরাহ বাড়ছে।’

বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে স্থানীয় কারণের চেয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে বেশি দায়ী করছে সরকার। বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। ওই সময় প্রায় একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। এরপর ২০২২ সালেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। যদিও বাংলাদেশের বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসা শুরু হলেও ভিন্ন চিত্র বাংলাদেশে।

২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। তারপর থেকেই সেটি ক্রমে নিম্নমুখী। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছিল ৩ দশমিক ১৫ শতাংশে। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি উঠে গিয়েছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশে। সেখান থেকে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানিতে ২০২২ সালের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে তা আড়াই শতাংশে নেমে এসেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকাও এ সময় দেউলিয়াত্ব কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও বড় সাফল্য দেখিয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের যেসব দেশেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে তারা সেটি নিয়ন্ত্রণে ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছে। আগ্রাসীভাবে সুদহার সমন্বয়ের মাধ্যমে রাশ টানা হয়েছে তারল্যের সরবরাহে। এর ধারাবাহিকতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকলেও সুদহার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছিল মুদ্রার বিনিময় হারও। এক পর্যায়ে সুদহার ও বিনিময় হার সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয়া হলে দেখা যায় এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিলম্বিত পদক্ষেপ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পেরেছে সামান্যই। এর মধ্যে রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা থেকে দীর্ঘদিন সুদহার সমন্বয় করা হয়নি। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। যদিও পুরো ২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়েই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। গত বছরের জুনের পর সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর গত আট মাসে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশীয় পয়েন্ট। সর্বশেষ চলতি মাসের জন্য ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

দেশে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা চলছে দুই বছর ধরে। এ সময়ে মার্কিন মুদ্রাটির বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। এরপরও দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ১১০ টাকা। যদিও এ দরে ব্যাংক কিংবা কার্ব মার্কেট (খুচরা বাজার) কোথাও ডলার মিলছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্তে বাংলাদেশে বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করে দেয়ার কথা বলা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল করতে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করা হলে ডলার সংকট কেটে যাবে। বিনিময় হারজনিত অস্থিরতাও হ্রাস পাবে। যদিও বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে এ নীতি অনুসরণ করে কোনো দেশই এখন পর্যন্ত সাফল্য পায়নি। বরং তা প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মুখে পড়ার নজির রয়েছে। বিশেষ করে রিজার্ভের দুর্বলতা, বিনিময় হারের অস্থিরতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি একই সঙ্গে বিদ্যমান থাকলে এ নীতি কাজ করে না। বরং তা বিনিময় হারের অস্থিরতাকে আরো উসকে দেয়ার পাশাপাশি হুন্ডির বাজারকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলায় ভূমিকা রাখে।

শুধু কঠোর ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে সঙ্গে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে বলেও মনে করছেন তারা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১১-১২ অর্থবছরের দিকে মূল্যস্ফীতি যখন বেড়ে গিয়েছিল, তখন সেটিকে নিয়ন্ত্রণের যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। সুদহার ১৩ থেকে বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ এবং ডলারের বিনিময় হার ৬৯ টাকা থেকে ৮৩ টাকা করা হয়েছিল। ত্বরিত এ পদক্ষেপের কারণে সে সময় মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমরা অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসার মূল কারণ হচ্ছে এটি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে নিস্পৃহতা। আমাদের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কারণে তা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিল যেমন সুদের হার বৃদ্ধি ও বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করেছি, যার ফলে এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।’

bonik barta

Exit mobile version