দেড় দশক আগে বাংলাদেশ থেকে জাহাজ রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। দেশীয় দুটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ রপ্তানি করে সেই সম্ভাবনার পথও দেখিয়েছিল। কিন্তু সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসতেও তেমন সময় লাগেনি। অর্থাৎ জাহাজ রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। গত ২০ মাসে কোনো সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করতে পারেনি বাংলাদেশ। আর গত পাঁচ বছরে সব মিলিয়ে মাত্র তিনটি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড যুক্তরাজ্যের এনজিয়ান শিপিং কোম্পানির কাছে একটি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করেছে। জাহাজটি নিবন্ধন হয়েছে অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডায়। চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডও ২০২০ সালের জানুয়ারির পর কোনো জাহাজ রপ্তানি করেনি।
উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশে বৈশ্বিক জাহাজ নির্মাণশিল্পের মন্দার মূল প্রভাব পড়েছিল ২০১১ সাল থেকে। মন্দার কারণে বাংলাদেশের অনেকগুলো রপ্তানি আদেশ বাতিল করে বিদেশি ক্রেতারা। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আবার ধাক্কা আসে এই খাতে। দুইয়ে মিলে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এরই মধ্যে রপ্তানিমুখী দুটি প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড ও ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের নেওয়া ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তবে বিশেষ নীতিসুবিধার ফলে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠান দুটির বেশির ভাগ ঋণ নিয়মিত হয়েছে এবং বাকিটার প্রক্রিয়া চলছে বলে তারা জানায়।
উদ্যোক্তারা জানান, নতুন করে তাঁরা এখন রপ্তানির কার্যাদেশ পাচ্ছেন। আবার দেশেও বিভিন্ন ধরনের জাহাজ ও জলযানের চাহিদা বাড়ছে। ফলে দেশীয় ও রপ্তানি আদেশ মিলিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজের নির্বাহী পরিচালক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণশিল্পে বৈশ্বিক মন্দার সময়ে রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ায় এই খাতে আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। তবে দীর্ঘদিন পর এখন আবার বৈশ্বিক বাজারে ছোট জাহাজের চাহিদা তৈরি হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারাও শিপইয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখছেন। আশা করছি, নতুন রপ্তানি আদেশ আসবে। রপ্তানির পাশাপাশি দেশীয় চাহিদাও আছে। তাতে এই খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমাদের আশা।’
জাহাজ ও জলযান ৪৫টি রপ্তানি
বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি করে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ। ২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ডেনমার্কে জাহাজ রপ্তানির মাধ্যমে এই অভিযাত্রা শুরু হয়। প্রথম রপ্তানি হওয়া জাহাজটির নাম ছিল এমভি স্টেলা ম্যারিস। কনটেইনার পরিবহনের উপযোগী করে তৈরি জাহাজটির রপ্তানিমূল্য ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। জাহাজ রপ্তানির দুই বছর আগে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি মোজাম্বিকে ফেরি রপ্তানি করেছিল।
এরপর ২০১০ সালে জাহাজ রপ্তানিতে যুক্ত হয় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের নাম। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটি জার্মানিতে একটি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে। জাহাজটির রপ্তানিমূল্য ছিল ১২৩ কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও উদ্যোক্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট জাহাজ ও জলযান রপ্তানি হয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ১৯। বাকিগুলো ফেরি ও বিভিন্ন ধরনের সমুদ্রগামী জলযান। এসব জাহাজ ও জলযান রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা।
এনবিআর ও উদ্যোক্তাদের তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি জাহাজ ও জলযান রপ্তানি করেছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এখন পর্যন্ত তারা বিশ্বের ১১টি দেশে ৩৩টি জাহাজ ও জলযান রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে সমুদ্রগামী জাহাজ ১৫টি। অন্যদিকে আনন্দ শিপইয়ার্ড ১২টি জাহাজ ও জলযান রপ্তানি করেছে। তারা সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করেছে চারটি।
রপ্তানিতে ঘুরেফিরে দুই প্রতিষ্ঠান
রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, দেশে রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০টি। তবে দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ এই খাতে এখনো রপ্তানিতে নাম লেখাতে পারেনি। চট্টগ্রামের এফএমসি ডকইয়ার্ড জাহাজ ও জলযান রপ্তানির চেষ্টা করলেও এখনো কোনো জাহাজ রপ্তানি করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
রপ্তানি না করলেও দেশীয় কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠী এই খাতে নজর দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, টিকে-সীকমের যৌথ বিনিয়োগে গঠিত ডেলটা শিপইয়ার্ড। এসব শিল্পগোষ্ঠী এখনো রপ্তানি না করলেও আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করেছে। যদিও এসব শিল্পগোষ্ঠী মূলত নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য নিজেদের কারখানাতেই জাহাজ নির্মাণ করছে।
আবার রপ্তানি আদেশ আসছে
আনন্দ শিপইয়ার্ড সর্বশেষ ২০২২ সালে যে জাহাজটি রপ্তানি করেছে, সেটির জন্য কার্যাদেশ পেয়েছিল জাহাজনির্মাণ শিল্পে মন্দা শুরু হওয়ার আগে। সেই কার্যাদেশের আরও তিনটি জাহাজ রপ্তানি করবে তারা। এসব জাহাজ তৈরির কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি নতুন রপ্তানি আদেশ পাওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। একই অবস্থা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডেরও। ওয়েস্টার্ন মেরিন সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে গত বছরের জুলাই ও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট সাতটি ছোট জাহাজ রপ্তানির কার্যাদেশ পেয়েছে। এর মধ্যে অয়েল ট্যাংকার, টাগবোট ও ল্যান্ডিং ক্রাফট রয়েছে।
উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব জাহাজ তৈরি করে, সেগুলো মূলত ছোট আকারের জাহাজ। আবার ছোটখাটো জলযানও নির্মাণ হয় এসব কারখানায়। এখনকার বিশ্ববাজারে এ ধরনের জাহাজের ভালো চাহিদা রয়েছে।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান
প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে অনেক দিন এই খাতে স্থবিরতা ছিল। এখন বিশ্ববাজারে জাহাজ রপ্তানির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।
এই সুযোগ যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলে জাহাজ রপ্তানি খাতে আবার সুদিন ফিরে আসবে। এ জন্য সরকারের সহায়তা ও ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা দরকার।