ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পরই (২০১০-এ) বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করে সরকার। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ চাহিদা না বাড়ায় পাঁচ বছরের মধ্যে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যানেও চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়। ফলে সেটি বাস্তবায়ন করতে গিয়েও হোঁচট খেতে হয়। চাহিদার চেয়ে ৫৭ শতাংশের বেশি উৎপাদন সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে বসিয়ে রেখে দিতে হচ্ছে উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ।
এমন অবস্থায় গত বছর আবারও বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এবার বিদ্যুতের পাশাপাশি সম্ভাব্য জ্বালানি চাহিদা ও উৎস বিবেচনায় নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। তবে এবারও চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি ধরা হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। এতে ২০৫০ সাল নাগাদ সম্ভাব্য চাহিদার চেয়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। আর বসিয়ে রেখে আগের মতোই এসব কেন্দ্রের জন্য দিতে হবে উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ।
২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যানের উৎপাদন পরিকল্পনায় ৩৫ শতাংশ এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ও ৩৫ শতাংশ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ ছিল। এবার সে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে প্রচলিত বিভিন্ন জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে উচ্চ ব্যয়ের হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা ধরা হয়েছে। ব্যয়বহুল এসব প্রযুক্তির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে।
এর বাইরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিঃসরিত গ্যাস ধরে রেখে তা থেকে কার্বন উৎপাদন এবং ওই কার্বন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। তবে কার্বন ক্যাপচার স্টোরেজ (সিসিএস) নামক জাপানের প্রস্তাবিত এ ধরনের প্রযুক্তি এরই মধ্যে অনেক দেশ বাতিল করে দিয়েছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস বিশেষত সৌরবিদ্যুৎকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যানে।
এবারের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতামতও বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে মাস্টারপ্ল্যানের ড্রাফট তথা খসড়ার ওপর মতামতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে তাদের বক্তব্যকে আমলে না নিয়েই গত ২৭ নভেম্বর পাস করা হয়েছে ‘সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান (আইইপিএমপি) ২০২৩’। গত দুবারের মতোই এবারের মাস্টারপ্ল্যানও বিদ্যুৎ খাতকে বিলাসীর ভুল পথেই পরিচালিত করবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মাস্টারপ্ল্যানের তথ্যমতে, ২০২১ দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। সে সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অতিরিক্ত ছিল সাত হাজার ৯০৭ মেগাওয়াট বা ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ১০ বছর পর ২০৩০ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮৭ মেগাওয়াট। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এতে ২০৩০ সাল নাগাদ চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৩১৩ মেগাওয়াট বা ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ২০৪১ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট। আর ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। ফলে ২০৪১ সালে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ২৩ হাজার ৯৩৬ মেগাওয়াট বা ৪৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। একই ধারাবাহিকতায় ২০৫০ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৭১ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট। তবে ওই সময়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। এতে ২০৫০ সালে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৪০ হাজার ৫৮৮ মেগাওয়াট বা ৫৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
বিলাসী এ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নকালেই বাতিলে কয়েক দফা দাবি জানিয়েছে উপকূলীয় পরিবেশ ও জীবনযাত্রা কর্মজোট (ক্লিন) এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন-বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী শেয়ার বিজকে বলেন, পূর্ববর্তী মাস্টারপ্ল্যানের মতোই এবারও সম্ভাব্য চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে। ফলে এ মাস্টারপ্ল্যান ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বাড়াবে। এছাড়া অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন বা সিসিএসের মতো প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এ মাস্টারপ্ল্যানে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি দ্রুত বাতিল করে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
সূত্রমতে, ২০১০ সালের মাস্টারপ্ল্যানে ২০৩০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনায় ২০৩০ সাল নাগাদ সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছিল সাড়ে ২৮ হাজার মেগাওয়াট। একইভাবে ২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যানে ২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৬১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনায় ২০৪১ সাল নাগাদ সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছিল ৫০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
এদিকে এবারের মাস্টারপ্ল্যানে ধরা হয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হবে কয়লার, ছয় হাজার ৭০০ মেগাওয়াট জ্বালানি তেলের, ২৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট গ্যাস ও এলএনজির, যার অর্ধেক সিসিএস প্রযুক্তির, চার হাজার ৮০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ১ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ, ২০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ, ছয় হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ, ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট হাইড্রোজেন ও পাঁচ হাজার মেগাওয়াট অ্যামোনিয়াভিত্তিক এবং ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট আমদানি করা হবে।
প্রসঙ্গত, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিক্স জাপান (আইইইজে) এ পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারকারীদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ রাখেনি। কিছু নাগরিক প্রতিনিধির সঙ্গে দুটি পরামর্শক সভা আয়োজন করা হলেও মূল প্রতিবেদনে নাগরিক মতামতের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এ পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় সংসদ সদস্য, এমনকি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা করা হয়নি বলে জানিয়েছে ক্লিন ও বিডব্লিউজিইডি।
শেয়ারবিজ