রাজস্ব আহরণে ধীরগতি এবার বাজেট বাস্তবায়নকে আরো শ্লথ করে দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে ৯৬ হাজার ১৪৪ কোটি ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৯১ হাজার ২৪১ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব এসেছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথমার্ধে আমরা ধরেই নেই যে ৪০ শতাংশের বেশি বাজেট বাস্তবায়ন হবে না। সে হিসেবে এবার তার চেয়েও কম বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে সরকারের দিক থেকে ব্যয় কমানোর একটি প্রবণতা তো ছিলই। তাছাড়া ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশ সরকার পরিশোধ করেনি। ফলে সেখানেও কিছুটা অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। তবে সামনের দিনগুলোয় সরকারের ব্যয় বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যয় অনেক বাড়বে। আর অর্থবছরের শেষ মাস অর্থাৎ জুনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হবে।’
সরকারের অর্থ সংকটের বিষয়টি সামনে আসে সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি এবং নগদ প্রণোদনার অর্থ বকেয়া পড়ার পর। চলতি বছরের শুরুতে এ দুই খাতের ভর্তুকির বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ভর্তুকির দায় মেটানোর উদ্যোগ নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত সারে ভর্তুকির বিপরীতে ১৩ ব্যাংকের অনুকূলে ৯ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা ও বিদ্যুতে ভর্তুকির বিপরীতে ২৮ ব্যাংকের অনুকূলে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। সব মিলিয়ে খাত দুটিতে ভর্তুকি বাবদ ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে ইস্যু করা হয়েছে ২০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড।
চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে প্রথম ছয় মাসে আয় হয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৫ কোটি টাকার রাজস্ব, যা এনবিআরের মাধ্যমে আহরণ লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ শতাংশ। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর রাজস্ব খাতে ২০ হাজার কোটি এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে কর-বহির্ভূত রাজস্বের ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার ৪৮ শতাংশ আহরণ হলেও এনবিআর-বহির্ভূত কর রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১৯ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে যদি দেখি তাহলে যেকোনো অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ব্যয়ের গতি তুলনামূলক শ্লথ থাকে। জুলাইয়ে এর গতি সবচেয়ে কম থাকে আর সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় শেষ প্রান্তিকে। বাজেটে অর্থ ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, সেটি সবসময় অর্জনযোগ্য হয় না। প্রথম দিকে উন্নয়ন ব্যয় কম হয় এবং শেষের দিকে বেশি হয়। প্রতি বছর মূল বাজেটের আকার বেড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাজেট বাড়ার গতি কিছুটা কমেছে। পাঁচ বছর আগে যে হারে বাজেট বাড়ত, গত দুই-তিন বছর তার চেয়ে কম হারে বাড়ছে। কিন্তু আকার তো বাড়ছে। ফলে বাস্তবায়নের হারও কম দেখাবেই। তাছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ বাড়ার কারণে সরকারের দিক থেকে উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও কিছু তো প্রভাব রয়েছেই। আগে বাজেটে পরিচালন উদ্বৃত্ত থাকত, মানে রাজস্ব আয়ের তুলনায় পরিচালন ব্যয় কম থাকত। ইদানীং কালে এ উদ্বৃত্তের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ফলে কম রাজস্ব আয় হওয়ার কারণে ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ধার করতে হচ্ছে। যে হারে ব্যয় বেড়েছে, সে হারে রাজস্ব আয় বাড়েনি। ফলে দেশজ সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা টান দেখা যাচ্ছে।’
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। অর্থবছরে জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে এর মাত্র ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। টাকার হিসাবে মোট ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে, যা বাস্তবায়নের হার হিসেবে গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আইএমইডির ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরের পর থেকে এটিই এডিপি বাস্তবায়নের সর্বনিম্ন হার। এর আগে গত অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি নাগাদ এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ বা ৭৪ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।
এবারো মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পাওয়া অর্থ ব্যয় করতে না পারায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কাটছাঁট করতে হয়েছে। কাটছাঁটের ফলে সংশোধিত এডিপি বা আরএডিপির আকার দাঁড়াল ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর আগে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপির অনুমোদন দেন। এ সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
এডিপিতে সরকারের অর্থায়ন ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা, যা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। আর প্রকল্প ঋণের আকার ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এখানেও বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত এডিপিতে মোট ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে।
এনইসি সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম বলেন, ‘বরাদ্দ কাটছাঁট করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা এবং অগ্রাধিকার পরিবর্তন হওয়ায় এটি করতে হয়। অর্থ ব্যয় করতে না পারায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমানো হয়েছে।’
প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি কম থাকার কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ঘাটতি ছিল। অনিশ্চয়তা ছিল। আর অনিশ্চয়তা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এখন নির্বাচনের পর স্থিতিশীল পরিবেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী সামনে কৃষি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষায় আরো অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন।’
মোট সংশোধিত এডিপির সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৮২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, যা টাকার অংকে ৬৩ হাজার ২৬৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর পরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। টাকার অংকে এর পরিমাণ ৩৭ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। গৃহায়ন ও কমিউনিটি খাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
Bonik barta