প্রথম এলওসির কিছু অংশ অনুদান হিসেবে দেয়ায় ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৮৬২ মিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালের ৭ আগস্ট এ-সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসির চুক্তি সই হয় যথাক্রমে ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ও ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর। তিন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের মোট ঋণ পাওয়ার কথা ৭ দশমিক ৩৬২ বিলিয়ন (৭৩৬ কোটি ২০ লাখ) ডলার। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৪৮৯২ বিলিয়ন (১৪৮ কোটি ৯২ লাখ) ডলার। মোট ঋণের মধ্যে তা মাত্র ২০ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এলওসির প্রকল্পগুলোয় ঋণ দ্রুত ছাড় করতে ভারতের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তবে নানা জটিলতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসির বিভিন্ন প্রকল্প খুব একটা এগোয়নি। আর প্রথম এলওসির একাধিক প্রকল্পও এখনও ঝুলে আছে। ফলে ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ঋণছাড় দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে। গত জুন পর্যন্ত ঋণের পাঁচ দশমিক ৮৭২৮ বিলিয়ন (৫৮৭ কোটি ২৮ লাখ) ডলার বা ৭৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ অর্থ আটকে ছিল। অথচ জুন পর্যন্ত প্রথম এলওসির ১৮২ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হয়েছে।
এদিকে গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ভারতের ঋণের আরও ১৬২ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে। তা যোগ করলেও ভারতের ঋণের এক দশমিক ৬৫১২ বিলিয়ন ডলার বা ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছাড় হয়েছে সাড়ে ১৩ বছরে। আর অবশিষ্ট রয়েছে পাঁচ দশমিক ৭১০৮ বিলিয়ন ডলার বা ৭৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, গত জুন পর্যন্ত প্রথম এলওসির আওতায় ছাড় করা হয়েছে প্রায় ৭৪৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। সে সময় পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল ১১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় এলওসির আওতায় গত জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৩৩৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। আর অবশিষ্ট ছিল এক দশমিক ৬৬৩২ বিলিয়ন ডলার, যা দ্বিতীয় এলওসির ৮৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। একইভাবে জুন পর্যন্ত তৃতীয় এলওসির আওতায় ছাড় হয়েছে ৪০৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। সে সময় অবশিষ্ট ছিল চার দশমিক ০৯৫২ বিলিয়ন ডলার, যা তৃতীয় এলওসির ৯১ শতাংশ।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে নানা ধরনের শর্ত থাকে। এর মধ্যে মূল সমস্যা নির্মাণ সামগ্রীর ৭৫ শতাংশ (ক্ষেত্রভেদে ৬৫ শতাংশ) ভারত থেকে আনতে হয়। এছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়েও ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে জটিলতা তৈরি হয়। অনেক সময় ভারতের মূল ঠিকাদার সাব কন্ট্রাক্ট দেয়, যারা মাঠ পর্যায়ে কাজে দক্ষ না। তাদের জন্যও প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। এছাড়া ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে শুধু ভারতীয় ঠিকাদারই অংশ নিতে পারে। এতে দেখা যায়, ভারতীয় ঠিকাদাররা অনেক সময় প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দর প্রস্তাব করেন। এসব জটিলতায় ভারতীয় ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী নয় বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো।
সূত্রমতে, প্রথম এলওসির আওতায় ১৫টি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১টি পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং একটি প্রকল্পের আংশিক বাকি থাকতেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। বাকি তিনটি প্রকল্প চলছে প্রায় এক দশক ধরে, যার সবগুলোই রেলওয়ের। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন গতি খুবই ধীর। এর মধ্যে একটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পথে। তবে বাকি দুটি প্রকল্প কবে নাগাদ শেষ হবে, তা সংশ্লিষ্টদের কেউ নিশ্চিত নন।
দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ১৫টি প্রকল্প নেয়া হলেও পরে তিনটি বাদ দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে দুটি শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। আর তৃতীয় এলওসির আওতায় বাস-ট্রাক কেনার দুটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। আরও ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। যদিও এর মধ্যে চারটি প্রকল্প এলওসি থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইআরডির সূত্রে জানা গেছে, এলওসি থেকে ঋণ ছাড়ের গতি কম হওয়ায় নতুন করে আর ভারতের গুচ্ছ ঋণ বা এলওসি না নেয়ার চিন্তা করছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতের এক্সিম ব্যাংকও এখন থেকে প্রকল্পভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে পৃথকভাবে ঋণ দিতে চায়। এছাড়া চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়েও এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যেমন এখন শুধু ভারতীয় ঠিকাদাররাই এলওসি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিতে পারেন। ফলে তাদের নির্ধারিত দরেই কার্যাদেশ দিতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশীদারত্বের বা জয়েন্ট ভেঞ্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও যাতে দরপত্রে অংশ নিতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
এলওসির কোনো প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ (কিছু ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ৬৫ শতাংশ) পণ্য বা সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে। এই শর্ত শিথিল করার জন্যও দরকষাকষি চলছে। কারণ সবসময় নির্মাণ সামগ্রী তথা রড, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি ভারত থেকে আমদানি করে কাজ করা সম্ভব হয় না।
প্রসঙ্গত, এক শতাংশ সুদে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে ভারত। ১৫ বছর মেয়াদি এ ঋণে গ্রেস পিরিয়ড পাঁচ বছর।
sharebiz