Site icon The Bangladesh Chronicle

১১ মামলা মাথায় নিয়ে পাহাড়কে অশান্ত করছে মাইকেল চাকমা

logo

এস এম মিন্টু
মুদ্রিত সংস্করণ

চট্টগ্রামের পার্বত্যঅঞ্চলে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেই অস্থিরতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্বজাতির হাতে খুন হওয়ার নেপথ্যে যিনি কারিগর তার নাম মাইকেল চাকমা। তিনি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র। পার্বত্যাঞ্চলে হত্যা মামলাসহ ১১ মামলার আসামি হয়েও তিনি বীরদর্পে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি এমনকি পাহাড়ে চাঁদাবাজি থেকে আসা অর্থ দিয়ে অস্ত্র কিনে পাহাড়কে অস্থির করে রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে কথিত ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি করেছে, তার সবই হয়েছে- এই মাইকেল চাকমার পরিকল্পনায়।

২৮ বছর আগে ‘শান্তি চুক্তি অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সেøাগান দিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করেছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। চুক্তির ২৮ বছর পরও পাহাড়ে লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। চুক্তির সময় জমা না দেয়া অস্ত্রগুলো রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক এই সংগঠনের হাতে। এর সাথে তাদের ভাণ্ডারে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অস্ত্র। অভিযোগ রয়েছে পাহাড়ে চাঁদাবাজি থেকে আসা অর্থ দিয়ে ইউপিডিএফ এসব অস্ত্র কিনছে। পাহাড়ে যে চাঁদাবাজি হয়- সেটা ওপেন সিক্রেট। নগদ টাকার বিনিময়ে আসে মাদক ও অস্ত্র।’ এসব অস্ত্র আনা হয় ‘ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে রয়েছে মিয়ানমারের স্থল সীমান্তও।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্বজাতির হাতে খুন হওয়ার নেপথ্য কাহিনী : একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে উত্তপ্ত এই জনপদটি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে এক গভীর ও অন্ধকার অধ্যায়ের স্মৃতি। এই অধ্যায় হলো উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং তপন জ্যোতিসহ (বর্মা) একাধিক রাজনৈতিক নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনা জনসমক্ষে এলেও, এর নেপথ্যের মূল পরিকল্পনাকারী মাইকেল চাকমা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য রাজনীতিতে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রসীত বিকাশ খীসা। এই নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মাইকেল চাকমা। অপর দিকে একই উপজাতি গোষ্ঠীর আরেক পরিচিত নেতা, শক্তিমান চাকমা, বেছে নেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ।

সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, এই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয় ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সে সময় চাঁদাবাজি, অস্ত্র চোরাচালানসহ ১৮টি মামলার দায়ে পতেঙ্গা থেকে র‌্যাব অস্ত্রসহ মাইকেল চাকমাকে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে মাইকেল চাকমার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এক রকম ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অন্য দিকে এই সুযোগে রাজনীতিতে ক্রমেই মূল নেতা হিসেবে প্রকাশ পেতে শুরু করেন শক্তিমান চাকমা। তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, এবং তিনি নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ক্ষমতার এই পটপরিবর্তন মাইকেল চাকমার মনে গভীর ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। মাইকেল চাকমার নেতৃত্ব ফিরে পাওয়ার এবং ক্ষমতাকে পাকা পোক্ত করার একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ান শক্তিমান চাকমা।

২০১৮ সালের ৩ মে উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা সকাল সাড়ে ১০টায় অফিসের উদ্দেশে মোটরসাইকেলে রওনা করেন। নানিয়ারচর উপজেলা কমপ্লেক্স গেটের ভেতরে পৌঁছা মাত্র ওঁৎ পেতে থাকা সশস্ত্র সদস্যরা তার দিকে গুলি ছুড়ে। এই হামলার মাধ্যমে জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড পুরো পার্বত্যাঞ্চলে গভীর আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি করে। নৃশংসতার এখানেই শেষ ছিল না। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন, ৪ মে, তার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য তপন জ্যোতিসহ (বর্মা) ১২ জনের দল খাগড়াছড়ি হতে নানিয়ারচর যাওয়ার পথে বেলা ১১টায় নানিয়ারচর থানাধীন বেতছড়ি নামক স্থানে পৌঁছা মাত্রই রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতে থাকা সশস্ত্র সদস্যরা গুলি ছুড়ে। চালকের হাতে গুলি লাগা মাত্র মাইক্রোবাসটি রাস্তার পাশে উল্টে পরে গেলে সশস্ত্র সদস্যরা কাছে এসে গুলি করলে তপন জ্যোতিসহ (বর্মা) তিনজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৯ মে শক্তিমান চাকমার বন্ধু ও সহকর্মী রূপস চাকমা বাদি হয়ে মাইকেল চাকমাসহ ৪৬ জনের নামে নানিয়ারচর থানায় মামলা করেন। একজন নেতা যখন নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিজ জাতির আরেক নেতা এবং নিজ দলের সহকর্মীদের হত্যা করতে পারে, তখন পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, মাইকেল চাকমা আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মতবিরোধের ফলে গুমের শিকার হন। পরবর্তীতে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি ছাড়া পান। গুমের বিষয়কে পুঁজি করে দেশবাসীর সহমর্মিতাকে কাজে লাগিয়ে আবার ইউপিডিএফের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছেন এবং বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া ও চ্যানেলে নিজেকে ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করে সুকৌশলে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়েছেন। যা খাগড়াছড়ি এবং গুইমারার ঘটনায় তার মিথ্যা বয়ান এবং আদিবাসী বিষয়ে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য এই বিষয়টি কে প্রমাণ করে।

মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলাসংক্রান্ত তথ্যাদি : নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে ১১টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও স্থানীয় সূত্র বলছে মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২০টিরও অধিক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ৩০ অক্টোবর রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানায় মো. দুলাল উদ্দিনের করা (মামলা নং-০৪) মামলার ১ নম্বর আসামি মাইকেল চাকমা এবং তার সহযোগীরা মিলে বাদি এবং অন্য জেলেদের বেদম মারধর করে সাথে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং নিয়মিত হারে চাঁদা দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। পরবর্তীতে, সেনা অভিযান পরিচালনা করে মাইকেল চাকমাকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করা হয়।

২০১৮ সালে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানায় রঞ্জন চাকমাকে (২৭) হত্যা করা হয়। ওই মামলাটি তার ভাই কালাবী চাকমা ১৮ জুন (এফআইআর নং ১) দায়ের করেন। ওই মামলায় মাইকেল চাকমা ১৮ নম্বর আসামি। রঞ্জন চাকমাকে দোকান থেকে ফেরার পথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

২০০৭ সালে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানার অন্তর্গত ভাইবোনছড়ায় খুন, চাঁদাবাজি এবং মারধরের ঘটনার তদন্ত অভিযানে আসামি মাইকেল চাকমাকে একটি দেশীয় অস্ত্র ও ছয় রাউন্ড গুলিসহ আটক করা হয়। ওই মামলার বাদি এএসআই মো: শরিফুল আলম এবং মামলা নং-৫। পরবর্তীতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং আসামিদের থানা হেফাজতে নেয়া হয়।

২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি থানায় নিরঞ্জন চাকমাসহ আরো দুইজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন মাইকেল চাকমা। মামলাটি নিরঞ্জন চাকমার স্ত্রী মিনা ঢাকমা দায়ের করেন। (মামলা নং-১)। ওই বছরের ২১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে তিনজন ব্যক্তিসহ মোট পাঁচজনকে ইউপিডিএফ ধরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তিনজনের গুলিবিদ্ধ লাশ ছোট তারাবুনিয়া এলাকায় পাওয়া যায়। বাকি দু’জন অপহৃত অবস্থায় ছিলেন। ওই মামলার ১ নম্বর আসামি মাইকেল চাকমা।

২০১৮ সালে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর থানায় শক্তিমান চাকমা (৫৫) হত্যা মামলাটি তার একান্ত সহকারী রূপম দেওয়ান করেন। (মামলা নং-২) মামলায় মাইকেল চাকমাকে ৩৭ নম্বর আসামি করা হয়। ওই সময় শক্তিমান চাকমাকে মোটরসাইকেলে অফিসে যাওয়ার সময় এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয়।

২০১৮ সালে নানিয়ারচর থানায় তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) এবং তার সহযোগীদের হত্যা করা হয়। ৮ মে ওই মামলাটি নীতিপূর্ণ প্রকাশ অচীন চাকমা বাদি হয়ে দায়ের করেন। (মামলা নং ০৩/১১) দায়ের করা মামলায় মাইকেল চাকমা ৩১ নম্বর আসামি। নানিয়ারচর উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের নিমিত্তে তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) তার সহযোগীদের নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িবহরে ইউপিডিএফ (মূল) সশস্ত্র হামলা করে তাদের সদলবলে হত্যা করে।

২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিএমপির পাহাড়তলী থানায় একটি মামলার আসামি মাইকেল চাকমা। ওই মামলা নম্বর-১০। মামলার এজাহারে অভিযুক্ত আসামি মাইকেল চাকমা। তার কাছ থেকে ১৯০ পিস ইয়াবা অবৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিজের কাছে রাখা হয়। ২০১১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি সিএমপির পাহাড়তলী থানার এফআইআর নং-৯/২৬। এই মামলায়ও আসামি মাইকেল চাকমা। মামলায় উল্লেখ করা হয়, দু’টি এলজি ও দুই রাউন্ড কার্তুজ অবৈধভাবে নিজ দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

২০১৮ সালে ১৮ জুনে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানায় সুরেন বিকাশ চাকমা (৫৫) হত্যা মামলাটি তার স্ত্রী বাসন্তী চাকমা এবং চাচাতো ভাই অনিল বিকাশ চাকমা। (এফআইআর নং-৪) দায়ের করেন।

মাইকেল চাকমা এই মামলায় চার নম্বর আসামি। সুরেন বিকাশ চাকমাকে জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে ঘর থেকে ধাওয়া করে রূপকারী বিলের পাশে ছড়ায় নিয়ে ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক গুলি করে এবং কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাইয়ে করা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানায় বন কুসুম চাকমাকে (৪০) হত্যা মামলাটির আসামি মাইকেল চাকমা। মামলায় তাকে চার নম্বর আসামি করা হয়েছে। বন কুসুম চাকমার ভাতিজা নিয়ন চাকমা বাদি হয়ে মামলাটি করেন। (এফআইআর নং-১)। মামলায় উল্লেখ করা হয়, বন কুসুম চাকমা জমিতে চাষ করা অবস্থায় জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে, ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক মাথায় ও শরীরে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানায় মিশন চাকমা (২৮) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মাইকেল চাকমা জড়িত থাকায় তাকে তিন নম্বর আসামি করা হয়।

মামলাটি দায়ের করেন নিহত মিশন চাকমার চাচাতো ভাই চয়ন চাকমা। (এফআইআর নং-৩) এফআইআরে উল্লেখ করা হয়, মিশন চাকমা দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে, ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক অস্ত্রের বাট, গাছের ডাল দিয়ে মাথা, ঘাড় এবং শরীরে স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করে ধানী জমির পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।

Exit mobile version