Site icon The Bangladesh Chronicle

হাসিনা দেশে ঢোকার ১৩তম দিনে খুন হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া

মোহাম্মদ শামসুদ্দীন

গণতান্ত্রিক ও ইসলামী বিশ্বের স্বীকৃতি অর্জন, দেশের অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তোলা, মুজিব শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) গুম–খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিভিষিকা থেকে মুক্তি, দিল্লিকে উপেক্ষা করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা এবং দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির কারণে আধিপত্যবাদীরা জিয়াউর রহমানকে কখনো মেনে নিতে পারেনি। ফলে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন তিনি। তাদের ষড়যন্ত্র নীরবে এগোচ্ছিল—তারা অপেক্ষা করছিল শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যার্পনের জন্য।

অবশেষে ১৭ মে ১৯৮১ দিল্লি শেখ হাসিনাকে ঢাকায় পাঠায়। মাত্র ১২ দিন পরই, ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাকশাল উচ্ছেদের সময় শেখ হাসিনা, তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া এবং বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। সেখান থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে তারা নয়াদিল্লিতে ছয় বছর অবস্থান করেন।

এদিকে মুজিব আমলে পৃথিবীর অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছিল—বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র নাকি ভারতের অধীন কোনো অঞ্চল? ঢাকা কি দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়? তা নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল।

জহির রায়হানের গুম হওয়ার মাধ্যমে ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে গুমের সংস্কৃতি চালু হয়। আর ২ জানুয়ারী ১৯৭৫ সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা ইতিহাস বিচার বর্হিভূত হত্যার কলঙ্ক জনক অধ্যায় রচিত হয়। হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা, আওয়ামী লুটপাটের কারণে সৃষ্ট ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে রাস্তায় লাশের স্তুপ, কাক আর কুকুরের সাথে মানুষের খাবারের টানাটানির চিত্র, বাসন্তির জাল পরার চিত্র আর এক দলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার ফলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বাকশাল পতনের পর খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ও ইসলামী বিশ্বের স্বীকৃতি অর্জনে ভূমিকা রাখে।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়ে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মর্যাদা লাভ করে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমান নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেন। মুজিব আমলে সীমাহীন লুটপাট, ভারতের লুণ্ঠন ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত হয়

এ অবস্থায় জিয়াউর রহমান দুটি বড় অর্থনৈতিক সিংহদ্বার খুলে দেন—

শ্রমশক্তি রপ্তানি এবং তৈরি পোশাক শিল্প (RMG)

-এ দুটি খাত পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিতে পরিণত হয়।

১৯৮১ সালে নয়াদিল্লিতে অবস্থানকালে ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৭ মে তিনি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন। জিয়াউর রহমান সরকার তার দেশে প্রবেশে কোনো বাধা দেননি; বরং বলা হয় জিয়ার ‘গ্রিন সিগন্যালেই’ দেশে ফেরেন হাসিনা।

কিন্তু তার আগমনের মাত্র ১২ দিন পরই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হন।

এ হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির মদত ছিল এবং শেখ হাসিনাকে প্রত্যার্পনের পরই তারা নীলনকশা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়।

বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান তার গ্রন্থ ‘এক জীবন এক ইতিহাস’-এ শেখ হাসিনার প্রথম লন্ডন সফরের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। সেখানে বিবিসির স্টুডিও সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন—‘আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে তার (হাসিনা) প্রথম লন্ডন সফরে আমি বিবিসির নিউজ রুমে তার জন্যে একটা চা-চক্রের ব্যবস্থা করি। উদ্দেশ্য ছিল বিবিসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া -যে চেষ্টা আমি তার পিতার জন্যেও করেছিলাম।

হাসিনা বিলম্বে এলেন, তাও এ দেশে সখ করে যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের বিরাট একটা দল নিয়ে। তারাই নেত্রীর মনোযোগ পাবার বেশি চেষ্টা করেছেন অর্থাৎ বিবিসির সাংবাদিকরা তার মনোভাব ও নীতি যাচাই করার সুযোগ পাননি।

এক পর্যায়ে সহকর্মী জন রেনার ও আমি তাকে স্টুডিওতে নিয়ে যাই। কথা ছিল জন ইংরেজিতে এবং আমি বাংলায় তার সাক্ষাৎকার নেব। উপক্রমণিকা হিসেবে জন জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশের বৃহত্তম দলের নেতা হয়ে তার কেমন লাগছে’? হাসিনা তার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই বলে দিলেন যে, ‘তার মোটেই ভালো লাগছে না’। বিস্মিত জন রেনার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন’? আওয়ামী লীগ নেত্রী বললেন যে, ‘রাজনীতি তার ভালো লাগে না, রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন’। আমাদের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে গেল।

জন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে আপনি রাজনীতিতে এসেছেন কেন’? হাসিনার কন্ঠে এবার রীতিমত ক্রোধ ফেটে পড়ল।

তিনি বললেন, ‘ওরা আমার পিতাকে হত্যা করেছে, আমার মাতাকে হত্যা করেছে, আমার ভাইদের হত্যা করেছে, আমি প্রতিশোধ নিতে চাই’।

জন রেনার আর আমি চোখে চোখে তাকালাম। আমি অনুনয়ের ভঙ্গিতে তাকে ইশারা দিলাম এবং রেকর্ডিং থামাতে স্টুডিও ম্যানেজারকে ইঙ্গিত দিলাম।

আমি বিনয়ের সঙ্গে হাসিনাকে বললাম যে, ‘সে কথাগুলো না বললেই তিনি ভালো করবেন, কেন না তিনি নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী হতে চান, জনসাধারণ আশা করে যে তিনি তাদের কল্যাণ করবেন; পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে কেন দেশের মানুষ ভোট দিয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রী করবে’? তার চোখের ভাষা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল যে তিনি আমার ওপর মোটেই খুশি হননি। যা হোক উপরোক্ত প্রশ্নটি বাদ দিয়ে আমরা দু’জনেই মোটামুটি সন্তোষজনক সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম।” (পৃ: ২২৮ – ২২৯ নম্বর পৃষ্ঠা)

রক্তাক্ত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আবারো দিল্লিতে আশ্রয় নেন। নতুন রাজনৈতিক সুবাতাস বইলেও ইদানিং কিছু কিছু নেতা ভুলে যাচ্ছেন—হাসিনার আগমনের ১৩তম দিনের জিয়াউর রহমানকে খুনের ইতিহাস।

আবার যদি তার প্রত্যাবাসন ঘটে—তাহলে ‘সেই ১৩তম দিন কেমন হবে’? এবার কারা লক্ষ্যবস্তু হতে পারে?

Source: https://www.dailyamardesh.com/politics/amdprapu7q0st

Exit mobile version