শেখ হাসিনার শাসনামলে তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন (১ হাজার ৭০০ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা সরিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকর গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার লুটপাট করেছেন। প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই তথ্য জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে আহসান মনসুর বলেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে। নতুন শেয়ারধারীদের ঋণ দেওয়া ও আমদানির অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে এই পাচার কার্যক্রম চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর বলেন, যে কোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতি। রাষ্ট্রীয় মদদে এই মাত্রায় ব্যাংক ডাকাতি বিশ্বের অন্য কোথাও হয়নি। ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এটা করা হয়েছে। অর্থ লোপাটে এস আলম গ্রুপ প্রতিদিনই নিজেদের নামে ঋণ অনুমোদন করেছে।
সাইফুল আলমের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন এমানুয়েল আরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভান এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, গভর্নরের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর মন্তব্যের জন্য তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি এবং ডিজিএফআইর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সাড়ে ১৫ বছর দেশ শাসনের পর শেখ হাসিনা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তাঁর শাসনামলে ভোট কারচুপি, বিরোধীদের কারাগারে পাঠানো ও নির্যাতন করা এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আহসান এইচ মনসুর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একজন সাবেক কর্মকর্তা। গত মাসে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংকের পরিচালকদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের তুলে নিয়ে এস আলম গ্রুপের কাছে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি তাদের পরিচালকের পদও ছাড়তে হয়।
ইসলামী ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, জোর করে ব্যাংক দখলের প্রক্রিয়ায় তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে তৎকালীন সরকার তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পরামর্শমতো ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ করা হতো।
গত সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবদুল মান্নানকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এই ব্যাংকটিসহ এস আলম গ্রুপ সাতটি ব্যাংক দখল করে নেয়।
সাক্ষাৎকারে গভর্নর বলেন, শেখ হাসিনার সময়ে ১২টি ব্যাংক দখল করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর অবস্থা নিরীক্ষা করার পর পাচারের অর্থ উদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেশে ও দেশের বাইরের আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে ওই ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলোর শেয়ার ভালোমানের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে পুনঃঅর্থায়নের পরিকল্পনা আছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর সম্পদ রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি’ গঠন করারও পরিকল্পনা করছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ যেসব স্থানে পাচারের অর্থ-সম্পদ রক্ষিত আছে, তা উদ্ধারের চেষ্টায় নিয়োগ করা হবে আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠান।
samakal