Site icon The Bangladesh Chronicle

হাসিনার বিচার শুরু

logo

নিজস্ব প্রতিবেদক
মুদ্রিত সংস্করণ
শেখ হাসিনা |সংগৃহীত

তিনি ইতিহাসের নির্মমতম স্বৈরশাসক : অ্যাটর্নি জেনারেল

হাজার হাজার মানুষ হত্যার জন্য দায়ী : সাক্ষী খোকন চন্দ্র

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন খোকন চন্দ্র বর্মণ নামে এক মাইক্রোবাস চালক। রোববার (৩ আগস্ট) দুপুরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই শুনানিতে তার বক্তব্য উঠে আসে বিচারিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বে।

বিচারিক পটভূমি : এই মামলার শুনানি হয় বিচারপতি গোলাম মোর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো: মোহতিউল হক এনাম চৌধুরী।

সাক্ষীর জবানবন্দী : রক্তাক্ত আগস্টের বিবরণ : সাক্ষ্য দিতে গিয়ে খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলি তার বাঁ চোখ, নাক ও মুখে আঘাত করে। তিনি বলেন, ‘ওই মুহূর্তে এক পুলিশ সদস্য আমার মুখের ওপর থেকে রুমাল সরিয়ে দেখে যে, আমি আর চোখে দেখতে পাচ্ছি না, নাক-মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। তার পর আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়।’

তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘হাজার হাজার নিরীহ ছাত্র-জনতা, শ্রমজীবী মানুষ ও সাধারণ নাগরিক হত্যার জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও শামীম ওসমান দায়ী। আমি আদালতের কাছে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

জেরা ও প্রাথমিক উত্তাপ : সাক্ষীর বক্তব্যের পর আসামি পক্ষের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো: আমির হোসেন তাকে জেরা করেন। প্রশ্ন করা হয়: ‘আপনি যাদের দায়ী করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে?’ উত্তরে খোকন বলেন, ‘না, কিন্তু আমি নিজ চোখে দেখেছি তারা কিভাবে এই নিপীড়নের ছত্রছায়া দিয়েছে।’

আইনজীবী আরো দাবি করেন যে, যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনকারীরা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, যাতে ১৩-১৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং বহু আহত হন। খোকন তা সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব রাজনৈতিক রূপকথা। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলাম।’

রাষ্ট্রপক্ষের ভাষ্য : শেখ হাসিনা ‘সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু’ : রাষ্ট্রপক্ষে মামলার সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এই বিচার কোনো প্রতিশোধ নয়, বরং ইতিহাসের কাছে দায় মেটানো। শেখ হাসিনা এই গণহত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী। তার বিরুদ্ধে দায় চাপিয়ে নয়, এই আদালতে আমরা তাকে আইনত জবাবদিহির মুখে দাঁড় করাতে চাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আসামিদের অনুপস্থিতি বিচারকে থামাতে পারবে না। জনগণ এই বিচারপ্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি ধাপ প্রত্যক্ষ করতে পারবে, যা হবে আগামী প্রজন্মের জন্য ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত।’

অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য : ইতিহাসের নির্মমতম স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান তার বক্তব্যে বলেন, ‘বিশ্বে অনেক স্বৈরাচার এসেছে- হিটলার, মুসোলিনি, স্ট্যালিন, কিন্তু শেখ হাসিনা তাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি শুধু একজন স্বৈরাচার নন, একজন মিথ্যার শিল্পী। হিটলার বেঁচে থাকলে তিনিও শেখ হাসিনার কাছে মিথ্যার ক্লাস নিতেন।’

তিনি ব্রিটিশ ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘১৬৪৯ সালে রাজা চার্লস প্রথমের মৃত্যুদণ্ড এবং পরে অলিভার ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর তার কঙ্কাল উত্তোলন ও জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা প্রমাণ করে যে, কোনো স্বৈরশাসকই বিচার এড়িয়ে যেতে পারে না।’

অভিযোগপত্রের সারসংক্ষেপ : মামলার অভিযোগপত্রে পাঁচটি পৃথক ঘটনায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগগুলো হলো : ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ১৫০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা এবং ২৫ হাজার জনকে আহত করার অভিযোগ। ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা। চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা। আর আশুলিয়ায় ছয় নিরীহ নাগরিককে আগুনে পুড়িয়ে মারা।

এই পাঁচটি ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি বা সর্বোচ্চ দায়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে।

রাজসাক্ষী ও বিচারপ্রক্রিয়ার অগ্রগতি : সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গত ১০ জুলাই রাজসাক্ষী হিসেবে আত্মসমর্পণ করে দোষ স্বীকার করেন। ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে ক্ষমা প্রদান করা হয়েছে এবং রোববার তিনি ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন। মামলার ধারাবাহিক শুনানি চলমান রয়েছে। শুনানি শেষে বিচারপতিরা মামলাটি পরবর্তী কার্যদিবস পর্যন্ত মুলতবি করেন।

পটভূমি : জুলাই বিপ্লব ও রাষ্ট্রীয় ভাঙন : ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতিত হয়। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা গঠিত হয়। ২ জুলাই একটি আদালত অবমাননার মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমান মামলাটি সেই ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

Exit mobile version