হাজার কোটি টাকা গিলল ১২ প্রতিষ্ঠান

আজকের পত্রিকা

ফারুক মেহেদী ও জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা

Money-Lounderingপ্রতীকী ছবিনজিরবিহীন ঋণ কেলেঙ্কারি আর গ্রাহকের আমানতের টাকা লোপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ছাড়া আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম শহীদ রেজা ও প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও আছে। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে আইএলএফএসএলে নিরপেক্ষ পর্ষদ বসানো হলেও আগেই গ্রাহকের জমানো প্রায় সব টাকা চুষে নিঃশেষ করা হয়েছে। পর্ষদ এখন টাকা ফেরত চাইলে খেলাপিরা উল্টো হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার কেউ কেউ ঋণের প্রায় পুরো টাকাই মেরে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

জানতে চাইলে আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক। আমরা তা আদায়ের চেষ্টা করছি। ঋণখেলাপিরা বলেন, আমরা তাদের খেলাপি বাড়িয়ে দেখাচ্ছি। বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ নেই। কারণ, আদালতে অসত্য তথ্য দিলে তার দায়
তো আমাদের ওপর বর্তাবে। আশা করি, সামনে আমাদের বকেয়া ঋণ আদায় বাড়বে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক, আইএলএফএসএলসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, ঋণ কেলেঙ্কারিতে বর্তমানে প্রায় পুরো ব্যাংক ও আর্থিক খাতই প্রশ্নবিদ্ধ। পরিচালকেরা পরস্পর যোগসাজশে একে অপরের ব্যাংক থেকে লোপাট করছেন টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের আমানতের টাকা নামে-বেনামে লুটে নেওয়ায় এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দেউলিয়া হয়েছে। এ রকমই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে আইএলএফএসএল। এর দেওয়া মোট ৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিই ৯১ শতাংশ বা ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। জানা গেছে, মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানই হাতিয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর আগে পি কে হালদার একাই প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুটে নেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেয়। তাদের কার্যক্রমে ত্রুটি থাকলে, তা দেখভালের জন্য পর্যবেক্ষক দেওয়া হয়। এরপরও কেউ অপরাধ করলে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
জানা যায়, আইএলএফএসএল থেকে ১১৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল এ কে এম শহীদ রেজার মালিকানাধীন পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেড। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি টাকায়। শহীদ রেজা ঋণ পুনঃ তফসিল করেও বকেয়া অর্থ পরিশোধে অনীহা প্রকাশ করছেন বলে জানা গেছে। কর্তৃপক্ষ আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছে।

এ বিষয়ে এ কে এম শহীদ রেজা বলেন, ‘ঋণের বিষয়ে না জেনে হঠাৎ করে কিছু বলা যাবে না। করোনার পর ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। তবুও ঋণ নিষ্পত্তি করতে চেষ্টা করছি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। মামলার ঝামেলা এড়াতে নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে হলেও ঋণ পরিশোধ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এটা নিয়ে আর এগোতে চাই না। সমস্যা সমাধানে যা যা করা দরকার, সবই প্রক্রিয়াধীন।’

জানা যায়, আজম জে চৌধুরীর মালিকানাধীন ইস্ট কোস্ট গ্রুপের আওতাধীন প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান পিএফআই সিকিউরিটিজ ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। একবার পুনঃ তফসিল করা সত্ত্বেও পিএফআই সিকিউরিটিজ ঋণের টাকা পরিশোধে গড়িমসি করে। বর্তমানে মোট পাওনা ১০৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। পাওনা আদায়ে অর্থঋণ আদালত-২-এ ১টি, ঢাকার সিএমএম কোর্টে চেক ডিজঅনারের ১৯টি এবং চেক প্রতারণার ১টি মামলা করা হয়। তাতেও টাকা ফেরত পাওয়ায় কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে পিএফআই সিকিউরিটিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি বেশি দিন হয়নি। তবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সঙ্গে আমাদের ঋণের লেনদেন হয়। সম্ভবত ঋণটা ২০১০ সালে নেওয়া হয়েছিল। সেই ঋণের একটা সেটেলমেন্ট হয়েছিল। ঋণ পুনঃ তফসিল হয়েছে। আর পাওনা দেওয়া হচ্ছে না বলে যে অভিযোগ, এটা মনে হয় পুরো ঠিক নয়।’

জানা যায়, বর্ণালী ফেব্রিকস লিমিটেড ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি টাকায়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম এ রশিদ এখন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ঋণ নেয় ২৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি টাকায়। পাওনা আদায়ে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-২-এ একটি মামলা করা হয়। বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি এম এ বারী ইঞ্জিনিয়ার এম এ রশিদের বেয়াই।

মদিনা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। বকেয়ার স্থিতি ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পাওনা আদায়ে মামলা হয়েছে চারটি। মদিনা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোয়েব সারওয়ার বলেন, ‘আমাদের ঋণের বিষয়ে আদলতে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কর্তৃপক্ষ। আমরা ঋণ নিয়েছিলাম ৫ কোটি। তারা বেশি করে সুদ দেখিয়েছে। আর প্রকৃত হিসাবে ৮ কোটি ৭৫ লাখ হওয়ার কথা নয়।’

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তবে বিষয়টি সহজ নয়। আসলটা ফেরত পেলেও সুদ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

চট্টগ্রামের মোস্তফা গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট রহমান শিপ ব্রেকার্স লি. এবং এমএম শিপ ব্রেকার্স লি. দুটি হিসাবে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। খেলাপি হওয়ায় পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। মূল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হেফাজুতুর রহমান ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও চেক ডিজঅনারের মামলা চলছে।
রহমান কেমিক্যালস ঋণ নিয়েছিল ৫০ কোটি টাকা; এখন পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকায়। সিমটেক্স টেক্সটাইলস ঋণ নিয়েছিল ৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা; এখন তা দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটি ২৮ লাখ টাকায়। এমার এন্টারপ্রাইজ ঋণ নেয় ২৮ কোটি টাকা; এখন বকেয়া ৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি টাকা; এখন দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটি ১৭ লাখ টাকায়। কমপ্লিট এডুকেশন আর অলটারনেটিভ ফাউন্ডেশন ১১ কোটি টাকার ঋণ নেয়; এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি টাকায়। সামান্নাজ সুপার অয়েল লিমিটেড ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি টাকা; সুদসহ বকেয়া ৭০ কোটি টাকা। এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড ৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়; এখন তা দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট পাওনা ৯৩৪ কোটি টাকার বেশি।

এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে জানা যায়, কেউ বিদেশি পালিয়েছেন, কেউ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন বলেন, যারা অর্থ পাচার ও লুট করে, তাদের সাজার আওতায় আনতে সময় লাগে। আবার আইনের ফাঁক গলে অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। এ জন্য একই অপরাধ বারবার ঘটতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে।