হক ও ইনসাফের জন্য বঙ্গবন্ধুর লড়াই

Daily Nayadiganta

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রথম শুনি তখন ১৯৫৪ সালে। সবেমাত্র মেট্রিক পাস করেছি। তিনি সিরাজগঞ্জ এসেছিলেন। সিরাজগঞ্জ কলেজের মাঠে বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। তখন সিরাজগঞ্জ ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উর্বর ক্ষেত্র, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক রাজধানীর মতো। মওলানা ভাসানী, কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবদুল্লাহ আল মাহমুদসহ অসংখ্য খ্যাতনামা মানুষের জন্মস্থান। এখানে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে থেকেছেন, মহাত্মা গান্ধী এসেছেন। ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এসেছেন। ফজলুল হক এসেছেন। ভারত উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কবি-সাহিত্যিকের পদচারণা ছিল সিরাজগঞ্জে। কারণ এই মহকুমার সাথে ভারতবর্ষ ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জায়গার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত চমৎকার। সিরাজগঞ্জের সাথে ইংল্যান্ডের ডান্ডির সরাসরি যোগাযোগ ছিল। কলকাতার সাথে যোগাযোগ ছিল। এখানকার লোকজনের জন্য ঢাকার চেয়ে কলকাতা যাওয়া সহজ ছিল। ব্রিটিশ শাসক ও পরে সরকারবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে তার অগ্রভাগে ছিল এই অঞ্চল।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে ধারণা এবং তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ডাক আমার কিশোর মনকে নাড়িয়ে দেয়। পরিণত বয়সে যা চেতনার গভীরে দৃঢ়ভাবে গেঁথে গিয়েছিল। এই মূল্যবোধগুলো আমি বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম কিন্তু মুজিবের কণ্ঠ সেগুলো আমার মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হতে সাহায্য করেছে।

শেখ মুজিবের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল ঠিক ১৮ বছর। ১৯৬৪ সালে যখন তার সাথে আমার কথা হয় তখন আমার বয়স ২৪, আর তার ৪২। সিরাজগঞ্জ মাঠে বক্তৃতা করার সময় শেখ মুজিবের বয়স ছিল ৩৪ বছর। তিনি যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি বক্তৃতায় এতই তুখোড় ছিলেন যে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনত। মুসলিম লীগকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। তিনি কেন মুসলিম লীগকে এত খারাপ বলছেন আমার মনে সেই প্রশ্ন জাগে। পরে ভেবে দেখি তিনি তো ঠিকই বলছেন।

শেখ মুজিব তখন মাঝারি সারির নেতা, আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন যুগ্ম সম্পাদকের একজন। পদবিতে কিছুটা পেছনের সারিতে থাকলেও তাকে দেখি বক্তৃতায় সবার আগে। প্রচণ্ড প্রতিবাদী কণ্ঠ। পরিণত বয়সে বুঝতে পারি তিনি কেন এই প্রতিবাদ করেছেন। এটা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পারিবারিকভাবে মুসলিম লীগের আবহ থেকে বেরিয়ে আমার যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল মুজিবের ওই বক্তৃতা। আমি সিরাজগঞ্জ কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম। মুজিবের বক্তৃতা আমার তরুণ মনে এমন রেখাপাত করেছিল যে, আজীবন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছি। ১৯৬৪ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে ময়মনসিংহ যাই। সেখানে সার্কিট হাউজে এক সকালে তার সাথে দেখা হয়। সেটিই ছিল তার সাথে আমার প্রথম ও শেষ সামনাসামনি কথা। তরুণ, তেজোদীপ্ত এক নেতা। আমি তাকে আমাদের ভিশন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তার উত্তর ছিল, ‘তোমরাই ভিশন ঠিক করবা।’ তার কথা আমাকে উজ্জীবিত করেছে। তিনি আমার মনে প্রতিবাদী হওয়ার বীজটি সেই ১৯৫৪ সালেই বপন করে দিয়েছিলেন। এই প্রতিবাদ হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিহত করা মুসলমানদের জিহাদেরও অংশ।

এরপর সিএসএস পরীক্ষায় পাস করে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ইসলামাদ চলে যাই। তখন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিশাল বৈষম্যটি হাতে-কলমে প্রত্যক্ষ করলাম। শুধু দেখাই নয়, বৈষম্যের ধরনটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ‘ইকোনমিক প্রব্লেমস অ্যান্ড প্লানিং ইন পাকিস্তান’ নামে একটি বই লিখি। সরকারি চাকরি করে এ ধরনের বই লেখা সহজ ছিল না। কিন্তু আমি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করিনি। তখন মুজিবের কথাই আমার মনে হয়েছে। ওই সময়ে তিনি ছয় দফা দাবি পেশ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য ফেরানোর জন্য। এতে ছিল বৈষম্য দূর করার কথা। মজার ব্যাপার ছিল, ছয় দফা শব্দটি প্রথম শুনি আইয়ুব খানের মুখে। আমি ভাবি আইয়ুব ছয় দফা, ছয় দফা করছেন, জিনিসটি কী? এসব বিষয়ে আমার কৌতূহল থাকায় খোঁজখবর নিতে শুরু করি। সব জানার পর ভাবি, ভালোই তো, শেখ মুজিবের ছয় দফার প্রচার করে বেরাচ্ছেন আইয়ুব খান। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে যে কয়েকজন বাঙালি অফিসার ছয় দফার কথা শুনেছেন তাদের মধ্যে সম্ভবত আমিই প্রথম। কারণ কেন্দ্রে বাঙালি অফিসার ছিলেন ১০ শতাংশ। প্ল্যানিং কমিশনে দুই-তিনজন ছিলেন। ২৪টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শুধু আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন বাঙালি ছিলেন, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার। বাকি সব মন্ত্রণালয়ে আইসিএস অফিসার ছিলেন। এই যখন অবস্থা, তখন পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখ দূর হবে কেন? তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখাই, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখ তো এখানেই। মুজিবের ছয় দফা ঠিক, একে সমর্থন দেয়া উচিত।

ছাত্রজীবনেও বুঝেছিলাম, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে ভাসানী-মুজিব যে পক্ষ নিয়েছেন সেটাই ঠিক। তাদের সেই চেতনা আমার মনে গেঁথে যায়। আমার বইটি লেখার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল সরকারকে প্রভাবিত করা এবং কিভাবে দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য করা হচ্ছে তা সবাইকে জানানো। পার্লামেন্টে সরকার বলছে, পূর্ব পাকিস্তানকে জনসংখ্যার অনুপাতে ৫৩ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে কিন্তু আমি হিসাব করে দেখি বরাদ্দ দেয়া হয় কিন্তু বাজেট ছাড় করা হয় না। বাজেট ছাড় করা হয় ৩৮ শতাংশ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রেহমান সোবহানসহ কেউ কেউ অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে ভালো লেখালেখি করছিলেন কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট ছিল না। আমি প্ল্যানিং কমিশনের ফিসক্যাল মনিটরিং সেকশনে থাকার সুবাদে সরকারি আর্কাইভ থেকেই উপাত্ত পাচ্ছিলাম। আরো মজার ব্যাপার ছিল, রাজধানী ইসলামাবাদের উন্নয়ন খরচ রাজস্ব বাজেটের মধ্যে রাখাই হয়নি। এটা ছিল একটি কৌশল। সেটি থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্য আরো বেড়ে যেত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে টাকা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে খরচের এটাও একটি প্রমাণ। যখন বৈষম্যের স্বরূপটি তুলে ধরে প্লানিং কমিশনের মধ্যে আমি একটি নোট সার্কুলার করি। তখন রায়হান শরিফ ছিলেন আমার ইমিডিয়েট বস, ডেপুটি চিফ অব ফিসক্যাল মনিটরিং সেকশন। রায়হান শরিফকে নোটে ইনিশিয়াল দিতে বললে তিনি রাজি হলেন না। বললেন, তুমি তো মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছ। প্রেসিডেন্ট বলছেন ৫৩ শতাংশ আর তুমি বলছ ৩৮ শতাংশ। তিনি আমাকেই নোটটি সার্কুলার করতে বললেন। আমি তাই করলাম। এ নিয়ে কমিশনে তোলপাড় শুরু হয়।

কমিশনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলেও আমি বিষয়টি ইতিবাচকরূপে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সরকার বলছে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমরা এত কিছু করছি, আসলে তা হচ্ছে না। এর প্রতিকার হওয়া উচিত। আমি নোটটি প্ল্যানিং কশিনের সেক্রেটারির কাছেও পাঠাই। নোট পাওয়ার পর ডেপুটি চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি হলেন প্ল্যানিং কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান। এর চেয়ারম্যান স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। ডেকে পাঠানোর কারণে মনে কিছুটা অনিশ্চয়তা যে তৈরি হয়নি, তা নয়। ভাবলাম চাকরি শেষ। তিনি আমাকে চারটি প্রশ্ন করলেন, আমি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম। ‘আর ইউ মিস্টার মান্নান? ইয়েস; হ্যাভ ইউ রিটেন দিস নোট? ইয়েস; ইজ ইট ইওর সিগনেচার? ইয়েস; অল দিজ ডাটা কারেক্ট? ইয়েস স্যার; গো।’ আমি চলে আসি।

তখন আমার বয়স কম। নোটের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ততটা অনুধাবন করতে পারিনি। সরকার ইচ্ছে করলে আমাকে বরখাস্ত করতে পারত। সরকারের গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করতে পারত, আমাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বের করে দিতে পারত। তা না করে আমাকে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ‘রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট চ্যাপ্টার’ ড্রাফট করতে বলা হলো। আমাকে ইঙ্গিত দেয়া হলো, আমার লেখায় যেন থাকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য কমে গেছে। আমি হিসাব করে দেখি বৈষম্য আরো বেড়েছে। আমি সেভাবেই চ্যাপ্টারটি ড্রাফট করি। তখন ড. মঈনুদ্দিন বাকাই ছিলেন ফিসক্যাল মনিটরিং সেকশনের চিফ। আমি কোনোভাবেই নতি স্বীকার করছি না দেখে আমাকে এক মাসের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ট্যুর প্রোগ্রাম দেয়া হলো। সরকারি চাকরিতে এ ধরনের ট্যুর প্রোগ্রাম পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। খুশি মনে দেশে আসি, পরিচিত সবার সাথে দেখা করি। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু মনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি চিফ। তার সাথে আমার অনেক কথা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম আমাকে ডেকে পাঠান। তার সাথেও কথা হয়। ট্যুর শেষে কর্মক্ষেত্রে ফিরে দেখি আমার ডেস্কে কোনো কাজ নেই। যদিও ওএসডি করা হয়নি। আমার ড্রাফট শেষ করার কাজ আরেকজনকে দেয়া হয়েছে। ড. বাকাই আমার সম্পর্কে লিখলেন, ‘দিস অফিসার নিডস ফরেন ট্রেনিং’।

আমার ড্রাফটি দেয়া হয়েছিল আমার দুই কলিগ জাবেদ আসফার ও খালেদ একরামকে। তাদের আমি শুধু অনুরোধ করি যেন আমার প্রতি অবিচার করা না হয়। তারা ছিল হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট। তারা আমার অনুরোধ রেখেছিল। তারা শুধু আমার রিপোর্টকে সমর্থনই করেনি, তারা লিখল, ‘মান্নান ভুল করেছে, আসলে বৈষম্য আরো বেড়েছে, ৪৭ না, হবে ৪৮ শতাংশ।’ এতে কেন্দ্রীয় সরকার আরো বেকায়দায় পড়ে। আমার ড্রাফটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফলে ‘রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট চ্যাপ্টার’ বাদ দিয়েই চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সরকার।

আমার এই প্রতিবাদী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনে, যা আমার আত্মসত্তার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। মুজিব একটি দরদি সমাজ গঠনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি হক ও ইনসাফের জন্য যে লড়াই করেছিলেন সেই লড়াই আজ আরো বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয়।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com