’স্যার’ ডাকা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক : সমাধানের উপায়

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২৫ মার্চ ২০২৩, ২০:৫৫
‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ না বললে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা রেগে যান বলে অভিযোগ আছে। – ছবি : বিবিসি

’স্যার’ সম্বোধন নিয়ে সম্প্রতি একটি ঘটনা বেশ আলোড়ন ফেলেছে বাংলাদেশে। রংপুরে একজন শিক্ষককে সেখানকার জেলা প্রশাসক ’স্যার’ বলতে বাধ্য করেছেন- এ অভিযোগে ওই শিক্ষক প্রতিবাদ জানালে তার খবর-ছবি অনলাইনে ভাইরাল হয়। আর শুরু হয় আলোচনা-বিতর্ক।

জানা গেছে, রংপুরে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সেখানকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। তার অভিযোগ জেলা প্রশাসক তাকে ’স্যার’ সম্বোধন করতে বাধ্য করেছেন।

পরে গণমাধ্যমে খবর আসে যে জেলা প্রশাসক ওই শিক্ষকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

ওই খবর ও ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

’স্যার না বলায় সাংবাদিকের উপর রেগে গেলেন কর্মকর্তা’, কিংবা ’সাধারণ মানুষ সেবা নিতে গিয়ে স্যার না বলায় প্রশাসনের কর্মকর্তার রোষানলে’, এমন খবর প্রায়ই উঠে আসে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে।

সরকারের পক্ষ থেকে সবসময়ই জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ’স্যার’ বা ’ম্যাডাম’ বলার কোনো আইন নেই। বরং সেবা করাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ।

কিন্তু তারপরও কেন এমন ঘটনা বারবার আলোচনায় আসে?

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে কাজ করা মো: আজিজুর রহমান বলছেন, ‘ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। এই মেন্টালিটি আছে যে আমাকে হয়তো সম্মান করা হচ্ছে না।’

সিভিল সার্ভিসে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আজিজুর মনে করেন, মানসিকতা একটা বড় কারণ। আর এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করি যে আসলে কেন প্রত্যাশা করবে, আমার অধীনে অনেকেই আমাকে সারাদিন স্যার বলে ডাকছে, এখন বাইরের দু’একজন যদি স্যার না বলে, সেটা ওভারলুক করা আমার পক্ষে খুবই সম্ভব।’

উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের নারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

সেই অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, একটা কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা পুরো আমলাতন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এই মানসিকতার বলবে না। কিন্তু সিংহভাগই দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরকম ভেবে থাকে। আর ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয় চলে আসে, যেমন- যানবাহন চলাচলে প্রাধান্য দিতে হবে ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো স্থানীয় পর্যায়ে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রতিফলন ঘটায়। এটি খুবই উদ্বেগজনক।’

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে সিভিল সার্ভিসে পাবলিক রিলেশনশিপ নিয়ে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। ট্রেনিংয়েও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের বারবার বলা হয়ে থাকে, তারা জনগণের সেবক।

কিন্তু আজিজুর রহমান মনে করেন, চাকরিতে যোগদানের পর বাস্তবতা বদলে যায়।

তিনি বলেন, ‘বাস্তবের কর্মপরিবেশে যখন সবাই প্রবেশ করে, তখন সেই বোধগম্যতা আর থাকে না। কারণ একটা চেইন এখানে এমনভাবে তৈরি করা, এ থেকে হুট করে বের হবার কোনো অবকাশ নেই। এই সংস্কৃতি পুরো সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত।’

পাশ্চাত্যের উদাহরণ টেনে রহমান বলেন, পুরো সিস্টেমটা আসলে ডেভেলপ করতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানও মনে করেন, শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে হবে না। তিনি একই সাথে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার ও রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলছেন।

তিনি বলেন, ‘এখানে রাজনীতি বা সরকারি শীর্ষ পর্যায়ে যে ঘোষণাটা আসে, সেটা বাস্তবায়নের জন্য উচ্চ বা মধ্যপর্যায়ে যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আছে, তাদের লিডারশিপটা আসলে এখানে জরুরি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আবার রাজনীতিবিদরাই সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করছেন, আমলাতন্ত্র তাদের পাত্তা দেয় না। এই সুযোগটা রাজনৈতিক নেতৃত্বই করে দিয়েছে।’

ইফতেখার যোগ করেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঔপনিবেশিক আমল থেকে আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি জনগণের সেবক থেকে আস্তে আস্তে জনগণের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। আর এ থেকে বেরিয়ে আসতে জনগণের প্রতিবাদ করা খুব জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘রংপুরের ঘটনাটা একটি ভালো উদাহরণ। জনগণের মধ্যে থেকেও যদি এরকম প্রতিবাদ আসতে থাকে, তাহলে একটা চাহিদা সৃষ্টি হয়, সেটার প্রতিফলন এক সময় ঘটতে বাধ্য। তবে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে হবে না। প্রতিবাদ সবাইকে করতে হবে।’

আজিজুর রহমানও বলছিলেন সাধারণ নাগরিকের সচেতনতার অভাবের কথা।

তিনি বলেন, ‘জনগণ সোচ্চার না, কার কাছ থেকে কতটুকু কিভাবে আদায় করা উচিত, তারা অনেক সময় বোঝে না। ফলে সেটার জন্যও অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সুযোগ পেয়ে যায়।’

এছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়া ও প্রশিক্ষণেও অনেক পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন কেউ কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই বেশি মানুষের সাথে মেশার অভ্যাস যদি থাকে, সেটা অনেক সময় ফ্রন্টলাইনার সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে সাহায্য করে, নিয়োগের সময় এগুলো দেখা উচিত।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রশিক্ষণে এই সংস্কৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত অবহিতকরণ নেই। ক্ষমতার ব্যবহার কিভাবে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটি আসলে প্রশিক্ষণের সময়ই প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

সূত্র : বিবিসি