দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের শোচনীয় হামলার দুই দিন পর ইসরায়েলিরা বিচ ক্যাম্পের ওপর বোমা হামলা চালায়। এই শিবিরে এটাই ওদের প্রথম হামলা নয়, ২০২১-এর মে মাসে বোমা হামলায় এই শিবিরের ১০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আটজনই ছিল শিশু। এইবার এই শিবির তিন দফায় হামলার শিকার হয়।
গাজায় যখন বোমা হামলা শুরু হয়, তখন আমার বিচ ক্যাম্পের স্কুলটার কথা মনে পড়ল। আমি জানি না, স্কুলটা আর টিকে আছে কি না। জানি না ওই শিশুরা আর তাদের শিক্ষকেরা বেঁচে আছেন কি না—আমি জানি না।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রায় সাড়ে ২২ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট্ট একটুকরা ভূমিতে ২৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে। তারা বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঠেকাতে চাইছে, তেমন কোনো অর্থবহ চেষ্টা দেখা যায়নি। গাজায় ৯ হাজার ৯০০ মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৪ হাজার ৮০০ জন শিশু।
অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে এখনো যাঁরা আছেন, তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ—পানি, জ্বালানি, খাবার, ওষুধ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। চিকিৎসকেরা অবশ না করেই অস্ত্রোপচার করছেন। বিদ্যুৎ ফুরিয়ে আসছে। ইনকিউবেটরে থাকা নবজাতকদের জীবনশঙ্কায় মায়েরা কাতর। মানুষ সমুদ্রের পানি খেতে বাধ্য হচ্ছেন। ১০ লাখের বেশি মানুষ এখন ঘরছাড়া।
হামাসের হামলায় ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। জিম্মি হয়ে আছেন আরও ২০০ জন। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ এবং নিন্দনীয়। ভুক্তভোগী ও জিম্মিদের মধ্যে অল্পবয়স্ক নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা গান শুনতে গিয়েছিলেন। তাঁরা কারও ভাইয়ের ছেলে বা ভাইয়ের মেয়ে। তাঁদের কেউ অলংকারের নকশা করতেন। কেউ কেউ কাজ করতেন কারখানায়। তাঁদের মধ্যে শান্তিকামী মানুষ ছিলেন। এসব মানুষের স্বজনদের তীব্র বেদনা বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।
কিন্তু এই হামলা দিয়ে ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর নির্বিচার বোমা হামলা, তাঁদের খাবার বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে সাফাই গাওয়া যায় না। যে ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন, সে অপরাধে তাঁদের শাস্তি হচ্ছে। ভয়াবহ ওই ঘটনার পর আমরা উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তির কথা বলেছিলাম। উল্টো দিকে সারা বিশ্বের রাজনীতিবিদেরা আত্মরক্ষার অধিকার আছে, এই যুক্তি দেখালেন। তাঁরা ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের মানুষকে খুন ও অভুক্ত রেখে হত্যার সবুজ সংকেত দিলেন।
গাজার প্রত্যেক মানুষের নাম আছে, আছে চেহারাও। গাজার ইনকিউবেটরে ছটফট করা নবজাতকের জন্য আমরা কাঁদি, যেমন কাঁদি দুর্ঘটনায় নিহত একজন বৃদ্ধের জন্য। আমরা সুন্দর কিছু প্রাণ, সৃষ্টিশীল জীবনের খোয়া যাওয়ায় বিপন্ন বোধ করি।
আমরা এমন কিছু শিল্পী হয়তো হারিয়েছি, যাঁদের চিত্রকর্ম আমাদের দেখার সুযোগ হলো না, যাঁদের গান আমাদের শোনা হলো না, যাঁদের লেখা বই আমাদের আর পড়া হলো না। এসব মানুষের মধ্যে তাঁরাও হয়তো ছিলেন, যাঁরা কুনাফা বানাতেন। তাঁদের হাতে তৈরি কুনাফা আমাদের খাওয়া হলো না। শিক্ষকদের কাছ থেকে শেখা হলো না।
আমি যত দূর মনে করতে পারি, গাজা মানেই টিভি স্ক্রিনে দেখানো ধ্বংসাবশেষ আর হতাশা। কিন্তু এই ধ্বংসাবশেষের নিচে আসলে নিঃশব্দে, সবার অগোচরে চাপা পড়ে আছে আমাদের মানবতা। সকালের কফি, ঈষদুষ্ণ পানিতে গা ভেজানো, কেনাকাটা করতে দূরে কোথাও যাওয়া, তাস পেটানো, বিছানার পাশে রাখা গল্পের বই। বন্ধুত্ব, মন ভাঙা, ভালোবাসা, হতাশা, বিরক্তি ও উদ্বেগ। স্কুল, মসজিদ, থিয়েটার, বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ ও হাসপাতাল। আশা, স্বপ্ন, ভয়, স্নেহ, আনন্দ। আমরা গণমৃত্যু প্রত্যক্ষ করছি। আমরা একটা সংস্কৃতি, একটা পরিচয়, একটা জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাওয়া দেখছি।