- হারুন-আর-রশিদ
- ০৪ মে ২০২০
১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রধান দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণÑ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কায়েম করা, দ্বিতীয় কারণটা ছিলÑ অর্থনৈতিক মুক্তি। এ দুটো ক্ষেত্রে আমরা ৪৯ বছর ধরে আশানুরূপ সফল হয়নি। গণতন্ত্র হয়েছে পেশিশক্তিতন্ত্র আর অর্থনৈতিক মুক্তিটা হয়েছে ধনীদের পকেটতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু একটি সুন্দর দেশ চেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের স্বপ্নটা ছিল ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকবে না। কোথাও অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। গরিব মানুষ সুচিকিৎসা পাবে। দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারবে। দেশের পরিবেশটা একটা সাজানো-গোছানো ছবির মতো হবে। মানুষ বেকার থাকবে না, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। কৃষি ও শিল্পকারখানায় স্বনির্ভর হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ৩ জুলাই ২০১৯ বলেছিলেন, যে দিকে তাকাই শুধু দেখি অসুস্থ পরিবেশÑ সমাজব্যবস্থায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। আমরা মুখে বলি দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি। আসলে তা কথার কথা। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সুস্থ পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশের সাথে জড়িত রয়েছে খাল, নদী, পানি, বন, গাছপালা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ। অনেকে শুধু টাকার জন্য ঢাকা শহরটাকে একটা কংক্রিটের শহর বানাতে ব্যস্ত। তারা শহরের মানুষ এবং পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গের উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। তাদের ষড়যন্ত্রের হাত এবং লোভের পরিধি বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে তারা মানুষ, পরিবেশ, প্রকৃতির সুস্থতা বুঝতে চাইছে না।
দেশে সুশাসনের ঘাটতির কারণে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এটা ৬ জানুয়ারি ২০১৭ বিআইবিএমের সেমিনারে বিশেষজ্ঞদেরও অভিমত। প্রজাতন্ত্র হলেই যে দেশে প্রজাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেখানেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন জারি হতে পারে, যেমন আমাদের দেশেও দেখেছি। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা বলবেন, তারা গণতন্ত্র দিয়েছেন। যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন তারা বলবেন, ক্ষমতাসীনরা গণতন্ত্রকে পাঠিয়েছে জাহান্নামে। প্রতি বছর প্রায় ২৫ থেকে ২০ হাজার বাংলাদেশী মৃত্যুবরণ করে বায়ুদূষণের কারণে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতিও নষ্ট হচ্ছে। এ জন্য দায়ী ব্যক্তি, ধর্ম নয়। যারা ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করে তাদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করাই সময়ের দাবি। ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সৌদি রাষ্ট্রদূত এ কথা বলেন (ইনকিলাব ১৩ এপ্রিল ২০১৪)। সব ধর্মের মানুষ যাতে একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারেÑ এরকম একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একটি রাষ্ট্রের চারটি উপাদানÑ ১. জনসমষ্টি; ২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড; ৩. সরকার; ৪. সার্বভৌমত্ব। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশে গণতন্ত্রের অপর নাম হলো একদলীয় শাসনব্যবস্থা। বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র পরমতসহিষ্ণুতা। সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান। ৩৯ নং অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংসদকে কার্যকর রাখার দায়িত্ব সরকারি দল ও বৃহত্তর বিরোধী দল উভয়েরই। নিয়ম-নীতি নয়, সব ক্ষেত্রেই যেন শক্তি প্রয়োগ করতে চাইছে সরকার। শেখ মুজিবের স্বপ্ন বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে মানুষের কাছ থেকে সাড়া মিলতে শুরু করেছে।’ স্বাধীনতার সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে আমাদের যাপিত জীবনে কখনো আশার আলো জ্বলে ওঠে, আবার কখনো নিরাশার বালুচরে পা আটকে যায়। জীবনবৃক্ষে সুখ-দুঃখ দু’টি ফুল ফোটে, জীবননদীতে চলে সাফল্য-ব্যর্থতার জোয়ার-ভাটা। এভাবেই এগিয়ে চলে জীবন। আমাদের জীবনের এই যে চলার পথ এখানে ব্যর্থতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা সফলতার পথ দেখায়। সম্প্রতি একটি বাক্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি রাজ্য, সেখানে রাজ্যসরকারের প্রধান হলেন মমতা ব্যানার্জি।
তিনি ঘুষখোর চোর-ডাকাত এবং খুনখারাবি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। সত্য কথা বলতে ভয় পান না। সম্প্রতি দিল্লির মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বলেছেন, ‘পশ্চিম বাংলায় দাঙ্গা লাগবে না। আমরা হিন্দু-মুসলমান এখানে ভালো আছি। নাগরিকপঞ্জির নামে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে যেসব কাজ করছেন তা বাংলায় প্রসারিত করলে সহ্য করা হবে না।’ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে মমতা ব্যানার্জির মতো সত্য কথাগুলো কেন বলতে চাইছে না? রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে বহু বছর ধরে। একে অপরের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা নেই। এমনকি আলেম সমাজের ঐক্য নেই- তারা এক হলে বাংলাদেশ আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের মতো এক আলেম আরেক আলেমের বিরুদ্ধে গালমন্দ করছেন। জনগণের প্রশ্নে যদি ঐক্য না থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? জাতীয় ঐক্য যেমন দু’টি বড় দলের মধ্যে নেই, তেমনি অন্যদের মধ্যে ঐক্য দেখছি না।
বিগত তিন মাস ধরে করোনাভাইরাস নামে একটি ভয়ঙ্কর জীবাণুর কাছে বিশ্বের সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষ অনেকটা পরাস্ত, অসহায় এবং গৃহবন্দী। পত্রপত্রিকায় অনেক বিশেষজ্ঞ লিখেছেনÑ মানবসৃষ্ট এসব ভাইরাস প্রকৃতি বিনাশের কারণে। জলবায়ুরও পরিবর্তন ঘটছে এসব ভাইরাসে। পঙ্গপাল তার মধ্যে একটি। পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার্থে গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী বাড়াতে হবে। করোনাভাইরাস প্রকৃতির পক্ষ থেকে একটি সতর্ক বার্তা, যাতে মানুষ সতর্ক হয়। দেশে যদি ১৯৭৪ সালের মতো দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাহলে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। অনেকে বলেছেন, এ জন্য একটি জাতীয় সরকার গঠন করা প্রয়োজন।হ
লেখক : গবেষক ও গ্রন্থকার