প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এসইসিআইয়ের ক্রয় চুক্তিতে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে দশমিক শূন্য ৩২ সেন্ট। সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ভারতীয় মুদ্রায় এ মূল্য দাঁড়ায় প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) ২ রুপি ৬০ পয়সা। আর বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ টাকা ৫২ পয়সায় (প্রতি ডলার = ১১০ টাকা ধরে)।
এর চেয়ে সামান্য কিছু কম মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে স্থানীয় দুটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে ভারতের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এসজেভিএন গ্রিন এনার্জি। রাজস্থানভিত্তিক দুটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে মোট ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে সম্প্রতি ২৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশটির বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি অনুযায়ী, এর মধ্যে একটি প্রকল্প থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) ২ রুপি ৫৭ পয়সায়। বাংলাদেশী মুদ্রায় হিসাব করলে এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ টাকা ৪০ পয়সায়। আরেকটি প্রকল্প থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) ২ রুপি ৬২ পয়সায় (৩ টাকা ৪৭ পয়সা)।
ভারতের মতো বাংলাদেশও এখন সৌরসহ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোয় নানা প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার খুলনা, মৌলভীবাজার ও রাজবাড়ী জেলায় মোট ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার তিনটি (প্রতিটির সক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট) সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিতে অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। কেন্দ্র তিনটি থেকে ২০ বছর মেয়াদে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এসব কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়বে ১০ টাকা ৯২ পয়সা। এতে সরকারের মোট খরচ হবে ১০ হাজার ৬১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো।
এর আগে গত বছরের শেষার্ধ্বে অনুমোদিত অন্যান্য সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গেও প্রতি ইউনিট ১০-১১ টাকায় বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছিল সরকার। ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সৌরবিদ্যুতের আরো চারটি ক্রয় চুক্তিতে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০ বছর মেয়াদি এসব চুক্তিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১১ টাকার আশপাশে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চারটিকে ২০ বছরে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট ৯৮১ মেগাওয়াট সক্ষমতার পরিবেশবান্ধব জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বর্জ্যভিত্তিক একটি বাদে বাকি সবগুলোই সৌরবিদ্যুৎভিত্তিক। এসব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে অনুমোদিত ক্রয় চুক্তিগুলোয় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা আছে প্রায় ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে থেকে শুরু করে প্রায় ১২ টাকার কাছাকাছি।
নবায়নযোগ্য খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ শর্তে ক্রয় চুক্তির বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো সৌরবিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি মূল্য প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ভারতের বিদ্যুৎ খাতে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকায় সেখানকার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কম দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে। আর বাংলাদেশে যথাযথ প্রতিযোগিতা গড়ে না ওঠায় এখানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতে খরচ পড়ছে ভারতের চেয়ে ৬-৭ টাকা বেশি। বিপিডিবিসহ গোটা বিদ্যুৎ খাতের ওপর থেকে আর্থিক চাপ কমাতে এ ব্যয় কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো ক্রয় চুক্তিতে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনতে সরকারকে সৌরসহ সব ধরনের বিদ্যুতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণে সহায়তা, সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ ও সৌর যন্ত্রাংশ আমদানিতে আরো নীতিসহায়তা দেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়া যেতে বলে মনে করছেন তারা।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা গেলে সৌরবিদ্যুতের দাম আরো কমানো সম্ভব। পাশাপাশি জমি এবং সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সহকারী সহায়তা দেয়া গেলে ক্রয় চুক্তিতে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনা যাবে। ভারতের ক্ষেত্রে জমি ও সঞ্চালন অবকাঠামোয় দেশটির সরকারের সহায়তা রয়েছে। যে কারণে সেখানে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে এসেছে।’
সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত সরকার মোট ১২টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছে। গত আট মাসে অনুমোদন হওয়া এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ১ হাজার ২৮১ মেগাওয়াট। বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্মাণ করা হবে। কেন্দ্রগুলোর প্রতিটিরই বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি ট্যারিফ ১০ টাকা বা এর বেশি।
বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রয় চুক্তিতে সৌরবিদ্যুতের দাম আগের তুলনায় কমে এসেছে। বিশ্ববাজারে সৌর প্যানেলের দাম এখন নিম্নমুখী। সামনের দিনগুলোয় এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে আরো সাশ্রয়ী ক্রয় চুক্তি করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ক্রয় চুক্তিগুলো আগের চেয়ে কম মূল্যে করা হচ্ছে। সামনে দিনগুলোয় আরো সাশ্রয়ী মূল্যে করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে সৌরবিদ্যুতের প্যানেলের দাম নিম্নমুখী। সামনে আরো কমে যাবে। এছাড়া এখন প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সৌরবিদ্যুতের ক্রয় চুক্তি হচ্ছে। সেখানে সাশ্রয়ী ট্যারিফকে প্রাধান্য দিয়েই চুক্তি করা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘মূলত চারটি কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুতের দামে পার্থক্য হচ্ছে। প্রথমত, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জমির মূল্য অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘ ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ করতে হয়, যা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হলে বিদ্যুতের ট্যারিফে প্রভাব ফেলে। তৃতীয়ত, সৌরবিদ্যুতে ভারত সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে, যা বাংলাদেশে এখনো সহজলভ্য নয়। আর চতুর্থ কারণ হলো বাংলাদেশে সৌর শক্তির চেয়ে ভারতে রেডিয়েশন দেড় গুণ বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হয় বলে সেখানে ইউনিটপ্রতি খরচও কমে যায়।’
নবায়নযোগ্য খাত নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। সংস্থাটির ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে প্রতি কিলোওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের গড় দাম দশমিক শূন্য ৫৩ সেন্ট। পাকিস্তানে এ দাম দশমিক শূন্য ৩২ সেন্ট। ভিয়েতনামে দশমিক শূন্য ৮৪ সেন্ট। সেখানে বাংলাদেশে প্রতি কিলোওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি গড় উৎপাদন ব্যয় দশমিক ১৫৫ সেন্ট।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রয়াসগুলো এখনো তেমন একটা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে (পিএসএমপি) মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির অবদান ২০২১ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে (২ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট) নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) গত অক্টোবর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের মোট সক্ষমতা ১ হাজার ১৯৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্রিডভিত্তিক সক্ষমতা ৩৭০ মেগাওয়াট এবং গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয় (অফ গ্রিড) এমন বিদ্যুতের সক্ষমতা ৮২৬ মেগাওয়াট। আবার বিপিডিবির হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্রিডভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৪৫৯ মেগাওয়াট।
সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও স্রেডার কর্মকর্তারা জানান, দেশে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে প্রয়োজনীয় জমির সংকট বেশি। জমি পাওয়া গেলেও তার মূল্য অনেক বেশি। ভারতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বড় একটি অংশ নির্মাণ হয়েছে রাজস্থানে বা মরু এলাকায়। আর ভারত নিজেই সৌর যন্ত্রাংশের বড় একটি অংশ উৎপাদন করে থাকে, যেখানে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। ভারতে এ খাতে বিনিয়োগের জন্য সরকারি সহায়তাও অনেক বেশি। বাংলাদেশে সেদিকে এগোলেও এখনো পথটা মসৃণ নয়। এছাড়া দেশটিতে বিদ্যুতের প্রতিযোগিতামূলক বাজারও এ খাতের অগ্রগতিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে জমি ও অবকাঠামোগত সহায়তা দেয়া গেলে সৌরবিদ্যুতের ক্রয় চুক্তিতে মূল্য কমিয়ে আনা যাবে বলে মনে করছেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) লিড এনার্জি অ্যানালিস্ট শফিকুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জমির সংকট ও উচ্চ মূল্য। একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রাংশ আমদানিতে নির্ভরতাও অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। যন্ত্রাংশের আমদানিনির্ভরতা কমানো না গেলেও জমির সংস্থানে সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আরো কমানো সম্ভব। এছাড়া সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প সঞ্চালন খরচ সরকার বহন করলে ট্যারিফ কমানো সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সুবিধা দেবে সরকারকে। এর বাইরে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা গেলে সৌরবিদ্যুতের ট্যারিফও ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব।’
Bonik Barta