Site icon The Bangladesh Chronicle

সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ এস আলমের বিরুদ্ধে

আল-আমিন
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৫: ৪৩

বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে নামে-বেনামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে ব্যাংক মাফিয়াখ্যাত এস আলম গ্রুপ। এই অর্থের বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৬টি মামলা দায়ের করেছে। পাশাপাশি আরো প্রায় ৩৪টি অভিযোগের তদন্ত চলছে।

দুদক জানিয়েছে, এস আলম গ্রুপ ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয় এবং ওই অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই গ্রুপটি ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে বলে অভিযোগ। তদন্তে উঠে এসেছে, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে ভুয়া চটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁর নামে প্রতিষ্ঠান খুলেও ঋণ নেওয়া হয়।

এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর অধিকাংশই হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। মানি লন্ডারিং, ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থপাচারের অভিযোগে এসব মামলা দায়ের করা হয়।

জানা গেছে, বেসরকারি খাতের সফল ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংক থেকেই তারা ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। এ ব্যাংকসহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রুপটি টাকা বের করে নিয়েছে, সব প্রতিষ্ঠানই এখন প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দুদক জানিয়েছে, বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত দেশে শুধু একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুই লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ এই প্রথম। এস আলম গ্রুপের এই হরিলুটে শুধু চেয়ারম্যান সাইফুল আলমই নয়; তার দুই ছেলে ও স্ত্রীও জড়িত। তাদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। যারা গ্রুপটির আর্থিক কেলেঙ্কারিতে সহযোগিতা করেছে, তাদের নামেও মামলা করা হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যে আরো ১৫টির অধিক অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মামলা রুজু করা হবে। আদালত ইতোমধ্যে এস আলমের নামে রেড নোটিস জারি করেছে।

এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আক্তারুল ইসলাম আমার দেশকে জানান, এস আলম গ্রুপের নামে এখন পর্যন্ত ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে এক হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

২০২৫ সালের ২৫ মার্চ এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্ত্রীসহ সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের নামে পৃথক মামলা দায়ের করা হয়।

এরপর ১৯ মে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। অর্থ লুটপাটে ৪৩ জনকে আসামি করা হয়।

১৯ আগস্ট ২০৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুল আলম, সিদকার গ্রুপের রন হক সিকদার, রিক হক সিকদারসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। অভিযোগে বলা হয়, চটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁ ব্যবসার নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড থেকে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়।

২৮ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরদিন ২৯ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা গায়েবের অভিযোগে তিনিসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। একটি মামলায় ৯ জনের বিরুদ্ধে ৫৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করা হয়। অন্যটিতে ৯টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে এক হাজার ৭৭ কোটি ১১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।

১৭ আগস্ট প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের বিপুল টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগে দুদক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল আলম এবং চট্টগ্রাম নগরীর লা-এরিস্টোক্রেসি রেস্তোরাঁর মালিক নাজমে নওরোজসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।

৩ সেপ্টেম্বর ৭৫ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগে সাইফুল আলমের দুই ছেলে ও কর কর্মকর্তাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর পে-অর্ডার জালিয়াতির অভিযোগে তার দুই ছেলেসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করে।

এগুলো ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনায় সাইফুল আলম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করে।

জানা গেছে, সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা এখন সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। তারা সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সেখানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। দুদকের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়েই সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করেছেন তারা।

দুদক জানিয়েছে, সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে একাধিক আদেশে আদালত অর্থ জব্দের আদেশ দিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একাধিকবার তলব করা হলেও তিনি দুদকে হাজির হননি। আইনগতভাবে মামলা মোকাবিলা না করে তিনি বরং উল্টো অন্তর্বর্তী সরকারকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্য উপদেষ্টাদের কাছে বিরোধ নিষ্পত্তির নোটিস পাঠিয়েছেন তার আইনজীবীরা। নোটিসে বলা হয়েছে, ছয় মাসের মধ্যে দুপক্ষ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে তারা আন্তর্জাতিক সালিশি কার্যক্রম শুরু করবেন।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর পাঠানো নোটিসে বলা হয়, সাইফুল আলমের পরিবার ২০১১ সালে সিঙ্গাপুরের পার্মানেন্ট রেসিডেন্স (স্থায়ী বসবাস) পাস এবং ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটির নাগরিকত্ব পেয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরাও ২০২০ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন বলেও আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েল অ্যান্ড সুলিভানের আইনজীবীদের পাঠানো ওই নোটিসে উল্লেখ করা হয়।

দুদক জানিয়েছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির মামলার আসামি সাইফুল আলমসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারির আদেশ দেয় আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ সাব্বির ফয়েজ এ আদেশ দেন।

পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলজুড়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক ব্যাংক দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। এ কাজে গ্রুপটিকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালীরা।

Exit mobile version