Site icon The Bangladesh Chronicle

সেবা রফতানির শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, তথ্য নিয়ে সংশয় দূতাবাসের

দেশের মোট রফতানিতে সেবা খাতের অবদান ১২ শতাংশ, অর্থমূল্যে যার পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এ খাতে রফতানির শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট সেবা রফতানির ১৮ শতাংশেরও বেশির গন্তব্য ছিল দেশটি। এ সময় বাংলাদেশ থেকে  যুক্তরাষ্ট্রে সেবা রফতানি হয়েছে ১২৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের। তৎকালীন বিনিময় হারে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।

দেশের সেবা খাতে রফতানি তথ্যের মূল উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ পরিসংখ্যানে গন্তব্য হিসেবে উল্লিখিত তালিকার শীর্ষ দেশগুলোর কাছে এ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায় খুবই কম। এমনকি বৃহত্তম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশ থেকে কী কী সেবাপণ্য রফতানি হচ্ছে, সে-সংক্রান্ত কোনো সুস্পষ্ট তথ্য দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় না। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকেও প্রকাশ করা হয়েছে সংশয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সরবরাহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিতভাবে সেবা রফতানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রফতানি হওয়া ‘‌সেবাপণ্য’ হিসেবে দেখানো হয়েছে সরকারি পণ্য ও সেবাকে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশে ‘‌সরকারি পণ্য ও সেবা’ রফতানি বাবদ আয় হয়েছে ২১৮ কোটি ডলার। দেশের বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশী কূটনৈতিক মিশনগুলোর কনস্যুলার সেবা থেকে অর্জিত অর্থ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দেয়া সেবা বাবদ বিদেশ থেকে আয়ও এখানে হিসাবে নেয়া হয়েছে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবা রফতানি খাতে বাংলাদেশের এখনো বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এ খাতে বাংলাদেশ এগোচ্ছে খুবই শ্লথগতিতে। এর বড় কারণ হলো সঠিক সেবা রফতানির যথাযথ জ্ঞানসম্পন্ন অপ্রতুল মানবসম্পদ। আরেকটি বড় কারণ উদ্যোক্তাদের মধ্যেও সেবা খাতের রফতানিযোগ্য পণ্য নিয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কম। আবার এ-সংক্রান্ত যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেটিও অসম্পূর্ণ। নানা মাত্রার সংশয় রয়েছে এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও।

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সেবা রফতানি-সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে ই-মেইল মারফত ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জবাবে দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘‌এ বিষয়ে আমাদের কাছে খুব বেশি একটা তথ্য নেই। মার্কিন সরকারি ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সেবা বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেলেও সেখানে দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা নেই। ওইসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালেও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় কোনো সেবা বাণিজ্য হয়নি।’

ইপিবি তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের খাতভিত্তিক সেবা রফতানি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ তালিকায় সরকারি পণ্য ও সেবার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হলো অন্যান্য ব্যবসায়িক সেবা। এর মধ্যে রয়েছে গবেষণা ও উন্নয়ন সেবা, পেশাদার এবং ব্যবস্থাপনা সেবা এবং কারিগরি, বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট ও অন্যান্য ব্যবসায়িক সেবা। এসব সেবা রফতানির মাধ্যমে অর্জিত অর্থমূল্য গত অর্থবছরে ছিল ১২০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।

তৃতীয় বৃহত্তম ক্ষেত্র হলো ট্রান্সপোর্টেশন বা পরিবহন। এর মধ্যে সমুদ্র ও আকাশপথে পরিবহন সেবাই বেশি। এ খাতে গত অর্থবছরে অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ১০৪ কোটি ৮২ লাখ ৯০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে সমুদ্রপথে পরিবহন সেবার ফ্রেইট বা ভাড়া বাবদ অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ১১ লাখ ৬৩ হাজার ডলার। অন্যান্য পরিবহন সেবা বাবদ অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৮৭ হাজার ডলার। দেশটিতে আকাশপথে পরিবহন সেবা বাবদ গত অর্থবছরে অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। পর্যটন খাতে গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৮ কোটি ৫৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার। অন্যান্য ভ্রমণ সেবা বাবদ অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ৯ কোটি ৪৩ লাখ ৫৮ হাজার ডলার।

এর বাইরে গত অর্থবছরে ব্যবসাসংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়ন সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ৫০ লাখ ৫৮ হাজার ডলার। এ ধরনের সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্জিত রফতানিমূল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে মার্কিন অনেক কোম্পানির ব্যাক অফিস রয়েছে। যেমন মার্কিন কোম্পানি অগমেডিক্সের হেলথ সেন্টারের ডাটা এন্ট্রি হচ্ছে বাংলাদেশে। লজিস্টিক্স সেবার অংশ হিসেবে শিপিং কোম্পানিগুলো অর্ডার ম্যানেজমেন্ট এবং কনসলিডেশন সেবার মাধ্যমেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করছে।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সেবা রফতানি খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মূলত বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ। সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়া এক্ষেত্রে অন্যতম। বিদেশে কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড পাঠানোর সমস্যাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সম্ভাবনার বড় জায়গা হলো বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট দক্ষ জনবল। এ জনবল ক্রমেই বাড়ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে সেবা রফতানির জন্য তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট দক্ষ জনবল বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ধীরে হলেও আমরা সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি।’

গত অর্থবছরে পেশাদার ও ব্যবস্থাপনা সেবা রফতানি বাবদ অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ ৮২ হাজার ডলার। সরকারি পণ্য ও সেবা খাতে গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কূটনৈতিক মিশনের সেবা বাবদ অর্জিত অর্থমূল্য ছিল ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রকেই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সেবার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌যুক্তরাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তি সেবার সবচেয়ে বড় বাজার। দেশটিতে  সেবা রফতানির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের যে সম্ভাবনা তা ৫ বিলিয়ন হোক বা ১০ বিলিয়ন ডলার হোক তা শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আসতে পারে। দেশটিতে এ মুহূর্তে ৩০ লাখ আইসিটি রিসোর্সের ঘাটতি আছে। বাংলাদেশে সফটওয়্যার বানিয়ে দেশটিতে সেবা হিসেবে রফতানি করছে। দেশটির ডেভেলপার লাগছে আর সেই ডেভেলপার বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ না ঘটার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সঠিক মানবসম্পদ। আমাদের কোয়ালিটি আছে কিন্তু কোয়ান্টিটি অব কোয়ালিটির ঘাটতি আছে।’

দেশের সেবা খাতের রফতানি সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্ভাবনা অনুযায়ী সেবা রফতানি এখনো অনেক কম। অনেক খাত এখনো রফতানির সরবরাহ চেইনে যুক্ত হয়নি। আবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড সার্ভিসেসের বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা বেশ সংরক্ষণমূলক। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু নিয়মনীতিও সেবা রফতানির পক্ষে সহায়ক নয়।

সেবা রফতানিতে মানের উন্নয়ন এখন খুব বেশি জরুরি বলে মনে করছেন ইপিবি-সংশ্লিষ্টরাও। এক্ষেত্রে দেশের চিকিৎসাসেবার উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, এটি উন্নত হলে এ দেশে বিদেশীদের সেবা নিতে আসার কথা ছিল। তাতে সেবা রফতানির আকারও বড় হতো। এখন হচ্ছে তার উল্টো। চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যেতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। অর্থাৎ সেবা রফতানির পরিবর্তে আমদানি করতে হচ্ছে। তথৈবচ দশা উচ্চশিক্ষাসহ অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রেও। নিজ ব্যবসার স্বার্থে হলেও বেসরকারি খাতকে এ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে খুব বেশি কিছু করার নেই।

Bonikbarta

Exit mobile version