Site icon The Bangladesh Chronicle

সুপ্রিম কোর্টের রায় কার জন্য অবশ্য পালনীয়?

সুপ্রিম কোর্ট হলো বাংলাদেশের উচ্চাদালত। আমাদের উচ্চ আদালত আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ সমন্বয়ে গঠিত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১১১ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরতাবিষয়ক। এ অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে- আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত যেকোনো আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১৫২ এ প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেÑ ‘আইন’ অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি। সংবিধানের একই অনুচ্ছেদে ‘আদালত’ বলতে সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনো আদালতকে বুঝানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টসহ অপরাপর আদালতের রায় চারটি অংশে বিভক্ত। এ অংশগুলো হলো- বাদি ও বিবাদির মামলা, বিচার্য বিষয়, আলোচনা ও সিদ্ধান্ত। মামলার সিদ্ধান্তটি হলো কার্যকর অংশ যার মাধ্যমে মামলার ফলাফল ব্যক্ত করা হয়। মামলার আলোচনা যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন কার্যকর অংশ খুবই সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। এ কার্যকর অংশটুকু হলো আদালতের আদেশ যা সংবিধান প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যায় আইনের অন্তর্ভুক্ত।

সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে হলে অপরাপর অনুচ্ছেদের সাথে এটির বিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন স্পষ্ট ধারণা লাভে সহায়ক নয়। এ ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদটির সাথে অপরাপর যেসব অনুচ্ছেদের সংশ্লেষ রয়েছে সম্মিলিতভাবে এসব অনুচ্ছেদের অধ্যয়ন প্রয়োজন। অনুচ্ছেদ নং ১১১-এর সাথে অনুচ্ছেদ নং ১১২-এর সংশ্লেষ রয়েছে। অনুচ্ছেদ নং ১১২তে বলা হয়েছেÑ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত সব নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সহায়তা করবেন।
অনুচ্ছেদ নং ১১১ অধ্যয়নে প্রতীয়মান হয়, এর দ্বারা শুধু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং উভয় বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় বলা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালত সমন্বয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ গঠিত। সরকারের অপর দু’টি অঙ্গ হলো নির্বাহী বা শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ। বিচার ও আইন বিভাগের প্রধান হলো যথাক্রমে প্রধান বিচারপতি ও স্পিকার। অপর দিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় নির্বাহী বা শাসন বিভাগের প্রধান হলো যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। সরকারের তিনটি বিভাগের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং একটি বিভাগের দায়িত্বে অপর বিভাগের হস্তক্ষেপ অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।

সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক মামলা সংশ্লেষে যখন কোনো রায় দেয়া হয় তখন সে রায়ে মামলায় বিজয়ী পক্ষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় মামলা সংশ্লেষে যে আইনি ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত দেয়া হয় তা সমরূপ মামলার ক্ষেত্রে প্রতিপালন সব আদালতের জন্য অপরিহার্য। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেন নির্বিঘেœ তাকে প্রদত্ত অধিকার ভোগ করতে পারে সে ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টকে নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্র্তৃপক্ষ কর্তৃক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি অনুচ্ছেদ নং ১১২ এ উল্লিখিত হয়েছে।

অনুচ্ছেদ নং ১১১ এর কোথাও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের ঘোষিত রায় আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের জন্য অবশ্য পালনীয় এ কথাটি বলা হয়নি। এ কথাটি না বলার যে কারণ তা হলোÑ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ ঢাকায় অবস্থিত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১০০ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে দেশের অপর কোনো স্থানে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে পারেন যদিও বাংলাদেশ অভ্যুদয় পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত কোনো প্রধান বিচারপতি ঢাকার বাইরে কোথাও এ ধরনের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেননি।

উল্লেখ্য যে, ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ঢাকার বাইরে ছয়টি শহরে হাইকোর্ট বিভাগের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যদিও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ওই সংশোধনী এখতিয়ারবহির্ভূত ও অকার্যকর ঘোষিত হলে অনুচ্ছেদ নং ১০০ পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের ঢাকার নিজস্ব কার্যালয় ব্যতীত অপর কোথাও কোনো ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারী না থাকার কারণে উভয় বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত রায়কে কার্যকর রূপ দেয়ার জন্য অপরাপর বিভাগের সহায়তা গ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। এরূপ সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ ও অধস্তন আদালত মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

দেওয়ানি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বা হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক একটি নির্দিষ্ট ভূমির ওপর বাদির স্বত্ব ঘোষিত হলে ওই ঘোষণা অনুযায়ী বাদি যেন নির্বিঘেœ তার ভূমি ভোগদখল করতে পারে এ বিষয়ে অনুচ্ছেদ নং ১১২ এর আলোকে সহায়তা প্রদান নির্বাহী বিভাগ ও অধস্তন আদালতের ওপর অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে ফৌজদারি মামলায় নি¤œ আদালত ঘোষিত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ বহাল রাখলে অথবা দণ্ডের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটালে রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ পুলিশ বিভাগ ও কারা কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায় এবং উভয় কর্তৃপক্ষ সে দায়িত্ব আইন অনুযায়ী নিষ্ঠার সাথে পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। অনেক সময় দেখা যায় যে, ভূমির ওপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ কর্তৃক বাদিকে স্বত্ববান ঘোষণা করা হয় ওই ভূমির সম্পূর্ণটুকু বা আংশিক জনস্বার্থে নির্বাহী বিভাগের অধিগ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। নির্বাহী বিভাগ বাদির ভূমি অধিগ্রহণের কারণে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ ওই ভূমির ওপর ঘোষিত বাদির অধিকার খর্ব হলেও এখানে বাদির স্বার্থের চেয়ে জনস্বার্থ অধিক গুরুত্ব পায়। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ ঘোষিত রায় নির্বাহী বিভাগের জন্য অবশ্য পালনীয় করা হলে তার পক্ষে কখনো অধিগ্রহণের মাধ্যমে বাদির ভূমির মালিকানা গ্রহণ সম্ভব নয়। ফৌজদারি অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। দায়রা অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ অপরাধ সংশ্লেষে একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলে তা নিশ্চিতকরণ বা অনুমোদনের দায়িত্ব হাইকোর্ট বিভাগের ওপর ন্যস্ত। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন পরবর্তী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কর্তৃক দায়েরকৃত আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নাকচ হলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষ পালন করে থাকে। এরূপ দায়িত্ব পালন সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদের আলোকে সহায়তার অংশ।

সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ ঘোষিত রায় বা আদেশ সংসদের জন্য অবশ্য পালনীয় করা হলে সে ক্ষেত্রে তা স্বাধীনভাবে সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতাকে খর্ব করে। সংসদ দেশের সাধারণ জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার ওপর কোনো ধরনের আঘাত দেশের জনমানুষের স্বার্থের প্রতি আঘাতসম। আর তাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ ঘোষিত রায় প্রতিপালন সংসদের জন্য বাধ্যকর নয়।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ অপরাপর বিচারকরা যেমন বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন অনুরূপ নির্বাচন কমিশনও সংবিধান ও আইনের অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী বিভাগকে যেমন সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তার কথা বলা হয়েছে অনুরূপভাবে নির্বাচন কমিশনকেও নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান উপরোক্ত দু’টি কর্তৃপক্ষের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলেও নির্বাহী বিভাগের সহায়তা ব্যতিরেকে ওই সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে পালন কখনো সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñ উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের দায়িত্ব পালনের জন্য অপরাপর আনুষঙ্গিক ছাড়াও একান্ত অত্যাবশ্যক অবকাঠামোর ব্যবস্থা করা নির্বাহী বিভাগের ওপর ন্যস্ত। নির্বাহী বিভাগ এ দায়িত্বটি পালনে প্রতিনিয়ত সহায়তা না করলে উভয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন নানাভাবে বিঘিœত হয়। আর এ কারণেই এ দায়িত্বটি পালনে নির্বাহী বিভাগ সর্বদা সচেষ্ট থাকে। উভয় কর্র্র্তৃপক্ষের পদধারীদের নিরাপত্তা বিধান এবং শান্তিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালনে সহায়তায় নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুলিশ বাহিনীর এরূপ সহায়তা ব্যতিরেকে বাস্তবতার নিরিখে উভয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে সাবলীলভাবে দায়িত্ব পালন দুরূহ।

সাংবিধানিকভাবে অধস্তন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া অধস্তন আদালতের রায় বা আদেশে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল ও রিভিশন দায়েরের অধিকার দেয়া হয়েছে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে আপিল বা রিভিশন দায়ের করা হলে প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের জন্য অধস্তন আদালতের সংশ্লিষ্ট বিচারিক নথি তলব অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক তলবের পরিপ্রেক্ষিতে অধস্তন আদালত কর্তৃক নথি প্রেরণ অপরিহার্য, যা সহায়তারই পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। সুপ্রিম কোর্টের রায় কার জন্য অবশ্য পালনীয় তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১১১ এ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত এ অবস্থানকে অপর কোনো কর্তৃপক্ষের ওপর প্রসারণের প্রয়াস নেয়া হলে তা ওই অনুচ্ছেদে ব্যক্ত চেতনার পরিপন্থী হবে। আর তাই অবশ্য পালনীয় ও সহায়তা

বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে যেসব কর্তৃপক্ষের উল্লেখ রয়েছে এর ব্যত্যয়ে পরিধির যেকোনো ধরনের সম্প্রসারণ আক্ষরিক অর্থে সংবিধানের ব্যক্ত অবস্থান হতে বিচ্যুতি। এ ধরনের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেয়া হলে তা অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কেরই জন্ম দেয়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

Exit mobile version