Site icon The Bangladesh Chronicle

সুগার ড্যাডি এবং মিডিয়া বেবি

সুগার ড্যাডি এবং মিডিয়া বেবি
(দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় কলাম )

উন্নত জীবনের আশায় পূর্ব ইউরোপের অনেক তন্বীতরুণী সুন্দরী পশ্চিম ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। সেখানে তাদের অনেক সচ্ছল ও বয়স্ক পুরুষ ‘লুফে নেয়’ বা আশ্রয় দেয়। এদেরই বলা হয় সুগার ড্যাডি, বাংলায় বলা যেতে পারে মিঠাই বাবা। আর আশ্রিতাকে বলা হয় সুগার বেবি। বাবা-কন্যা বা দাদা-নাতনির বয়সের হলেও এরা একজন আরেকজনের কাছে ঠিক সুগার বা মিঠাইয়ের মতোই মিষ্টি।

ফিল্মি পাড়ায় এ ধরনের সুগার ড্যাডি ও সুগার বেবির কথা প্রায়ই বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এই মিঠাই বাবাদের হাতে থাকে আবার হরেক রকমের মিঠাই। আর্থিক মিঠাইয়ের সাথে সাথে কারো হাতে থাকে সাংস্কৃতিক মিঠাই, কারো হাতে রাষ্ট্রীয় মিঠাই। মিঠাইয়ের চৌম্বক ধর্মের কারণেই মিঠাই কন্যারা তাদের প্রতি আকর্ষিত হয়। এগুলোর নব্বই শতাংশ গোপন থাকে। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটি ব্যাক ফায়ার করে বসলেই সেগুলো জনসাধারণের গোচরে এসে পড়ে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কিছু গ্লোবাল সুগার ড্যাডি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মিঠাইকন্যা হিসেবে বেছে নেয়া হয় টার্গেট করা দেশটির বা ভ্যাসাল স্টেটটির দল বা গোত্রবিশেষকে। সিকিমের লেন্দুপ দর্জির সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস দলটি ছিল পাশের দেশটির কাছে এরূপ একটি সুগার বেবি। নিজেদের সুগার বেবিদের ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে সেই সব দেশের স্বাধীনচেতা বা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
বৈশ্বিক এই সুগার ড্যাডিদের হিসাব একটু ভিন্ন ধরনের। কাউকে যেমন বিষ খাইয়ে মারা যায়, তেমনি সেই কাজটি মিঠাই খাইয়েও করা সম্ভব। এই মিঠাই খাওয়াতে হয় একটা পরিকল্পনার অধীনে এবং একটা লম্বা সময় ধরে। এই মিঠাই খাওয়ানোর কর্মটি সম্পাদন করা হয় সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ তথা মিডিয়া ও বিনোদন জগতের বিভিন্ন আউটলেট দিয়ে। সে লক্ষ্যেই রাজনৈতিক আগ্রাসনের আগে মিঠাই প্রয়োগে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও চালানো হয়।
আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন এ দেশের পত্রপত্রিকাকে মারার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। দুটি পত্রিকা (পরে চারটি ) সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাদবাকি সব পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। তবে এভাবে ডাইরেক্ট অ্যাকশন তখন সফল হয়নি।

এর পরই বিশেষ জায়গা থেকে মিঠাই বাবার আবির্ভাব হয়। বিষের বদলে মিঠাই খাওয়ানো শুরু হয়। এই পদ্ধতিটি অনেক নিরাপদ, প্রীতিকর তো বটেই। সুযোগ মতো কিছু জাতীয় আবেগ ও চেতনাকেও এই মিঠাইয়ের মধ্যে ভরে ফেলা হয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মিডিয়া জগতকে এই মিঠাই খাওয়ানোর কাজটি অব্যাহত রয়েছে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। টক, ঝাল বাদ দিয়ে শুধু মিষ্টি খাওয়ার সুবাদে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মিডিয়া জগত ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা জানি, ডায়াবেটিস হলে শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যায়। ইনসুলিনের কাজ হলো, রক্তের মধ্যে বিরাজমান গ্লুকোজ বা শক্তিকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সরবরাহ করা। ইনসুলিনের অভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ব্যাহত হওয়ায় শরীরের আবশ্যক অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো জ্বালানি বা প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে ড্যামেজ হয়ে পড়ে।
রক্তের ইনসুলিনের মতো হুবহু মিডিয়ার ইনসুলিন হলো, এর বস্তুনিষ্ঠতা। মিঠাই বাবা এই বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে নিরপেক্ষতা নামক মিষ্টি আমাদের সফ্টওয়্যারে ইনস্টল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ আমাদের চিন্তার জগতটিকে আলগোছে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আমরা এখন সর্বদা নিরপেক্ষতা তালাশ করি, বস্তুনিষ্ঠতা খুঁজি না।

মিডিয়ার ইনসুলিনের (বস্তুনিষ্ঠতার) অভাবে সমাজে বা রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এ দেশের বিবেক বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তারা এখন সত্য কথা বলতে ভয় পান। কিছু বলার আগে প্রথমে ভাবেন এতে তার ‘নিরপেক্ষতা’ নষ্ট হয়ে যাবে কিনা। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুটা সত্য বললে বিএনপি হয়ে পড়ার ভয় থাকে আর কোনো কোনো ব্যাপারে একটু বেশি সত্য বললে এমনকি জামায়াত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়।

কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার অপহৃত হলে একটি সাপ্তাহিকের জনৈক সম্পাদক এর বিরুদ্ধে একটি লেখা অন লাইন পোর্টাল এবং ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছেন।
ফরহাদ মজহার যেহেতু এই সরকারের কঠোর সমালোচক, কাজেই তার অপহরণের এ ঘটনার নিন্দা জানালে বিএনপি-জামায়াত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার রিস্ক থেকে যায়। সরকারের বিরাগভাজন হবার সম্ভাবনাও প্রবল। তাই নিরাপদ হলো, আগে নিজের নিরপেক্ষতার যথেষ্ট প্রমাণ হাজির করা। তারপরে যতটুকু সম্ভব, সত্য কথাটি বলা।
ওই সাংবাদিক প্রথমেই আক্রমণ চালালেন শফিক রেহমানের ওপর। এই নিরপেক্ষ খিচুরির এক নম্বর কাহিনীতে একুশে টিভি বন্ধ হওয়ার ঘটনাটি টেনেছেন। এই টিভি বন্ধ হওয়ার জন্য সেদিন শফিক রেহমানের বাসায় মিষ্টি খাওয়া খাওয়ি (?) হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আসলে একুশে টিভি বন্ধ হয়েছিল একটি মারাত্মক অনিয়মের কারণে এবং তা কোর্টের নির্দেশে। প্রকৃত ঘটনাটি একটু পরে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে।
দুই নম্বর কাহিনীতে ২১ আগস্টের ঘটনাটি বিবৃত করা হয়েছে। ২১ আগস্ট ঘিরে জনমনে সৃষ্ট অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে এখানে সরকারদলীয় বর্ণনাটিই পুরাপুরি তুলে ধরা হয়েছে। এই দু’টি বর্ণনায় সরকারপক্ষ এতটুকু খুশি হবে যে, এখন তাদের দু-একটি অপকর্ম উল্লেখ করলেও আর তেমন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।
তিন নম্বরে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম এবং চার নম্বরে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা দু’টি অত্যন্ত ঈমানদারীর সাথেই বর্ণনা করা হয়েছে। তিন এবং চার নম্বর বর্ণনাটি একজন বিএনপি সমর্থকের এতটাই ভালো লেগে যাবে যে, এক নম্বরে শফিক রেহমানের বাসায় মিষ্টি খাওয়ার হলুদ গল্প এবং দুই নম্বরে ২১ আগস্টের বর্ণনাটিও একটু অস্বস্তিসহকারে হলেও গ্রহণ করে ফেলবে। ইনি দুই দুই করে নিক্তি দিয়ে মেপে লেখাটিকে নিরপেক্ষ বানিয়েছেন! এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করে নিরপেক্ষতার স্কেলে আরো একধাপ উপরে উঠে গেছেন! কারণ কয়েক দিন আগে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যে ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে শহীদ মিনারে অপাংক্তেয় ঘোষণা করা হয়েছিল, সেখানে তার নামটিও ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিকতার নামে তারা এভাবে নিরপেক্ষতার দাঁড়িয়াবান্দা খেলে একটি ঘটনার প্রকৃত চিত্র পুরোপুরি পাল্টে ফেলেন। নিরপেক্ষতার এই খেলায় বস্তুনিষ্ঠতা পেছনে পড়ে যায়। সবকিছুকে এভাবে ‘নিরপেক্ষ’ বানালে প্রতিবাদের ভাষাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কারেক্টটিভ অ্যাকশন ধীর হয়ে যায়। এই সবই মিডিয়ায় ডায়াবেটিসের প্রভাব।

এবার আসুন দেখি, একুশে টিভি নিয়ে সেদিন কী ঘটনা ঘটেছিল। হাইকোর্ট যেদিন ইটিভির মালিক এসএ মাহমুদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন, সেদিন শফিক রেহমান ফোবানা সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে অবস্থান করছিলেন। সেদিন যায়যায়দিন অফিসে কোনো মিষ্টি খাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি নিয়ে যায়যায়দিন একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে রায়টি হওয়ায় এক ধরনের পেশাগত তৃপ্তি পেলে তা অপরাধ নয়। কারণ তাদের অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসে যে, শেখ হাসিনার সরকার বেসরকারি টিভি লাইসেন্সের জন্য একটি টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। তাতে উল্লেখ ছিল, এটি দেয়া হবে একটি কর্পোরেট বডিকে, ব্যক্তি বিশেষকে নয়। কিন্তু লাইসেন্সটি দেয়া হয় ব্যক্তিগতভাবে জনাব মাহমুদকে, ইটিভি লিমিটেডকে নয়। বিষয়টি যখন ইটিভির অন্যান্য পরিচালক এবং বিনিয়োগকারীরা জেনে যান, তখন তারা সঙ্গত কারণেই এসএ মাহমুদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। ব্যবসায়িক পার্টনাররা এটাকে তাদের সঙ্গে ‘সুস্পষ্ট প্রতারণা’ হিসেবে বিবেচনা করে সবাই তার বিরুদ্ধে চলে যান। মাহমুদ তখন সম্ভাব্য আইনি ঝামেলা এড়াতে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর ২০০২ সালে বিএনপির আমলে হাইকোর্টে রায়টি দেয়া হয়। কিছু দিন পরে লন্ডনেই মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ইটিভি বেআইনি বা অনৈতিকভাবে টেরিস্টেরিয়াল সম্প্রচারের চ্যানেলটি ব্যবহার করত যেটি স্যাটেলাইটের সাহায্য ছাড়াই ব্রডকাস্ট হতো। এটি ছিল বিটিভির সেকেন্ড চ্যানেল যেটি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। এই চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে দেশের কোথায়ও ডিশ অ্যান্টিনা ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বিটিভি বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে একটি অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। একইভাবে দেশের অন্য দু’টি প্রাইভেট টিভি স্টেশন যারা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাদের অনুষ্ঠান ব্রডকাস্ট করত, তারাও অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যায়। ইটিভির জনপ্রিয়তার কারণে তাদের মালিকের এই অনিয়মটি চাপা পড়ে ছিল।

তারপরেও বলা যায়, মিডিয়ার স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় এখানে বিষয়টি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ঠিকভাবে হ্যান্ডল করতে পারেনি। হাইকোর্টের রায়ের পর তারা নতুন করে আবার একটি টেন্ডার দিতে পারত এবং সেই টেন্ডারে ইটিভির অংশগ্রহণের একটা সুযোগ থাকত। তা না করায় জনগণ ধারণা করে যে, ইটিভির বিরুদ্ধে সরকারের ক্ষোভই হাইকোর্টের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তু সেই ভুল ধারণাটি অপসারণে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে ইটিভি কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিরাট অনিয়ম ঢেকে ফেলে এক ধরনের অনুকূল আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

এখানে হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে শফিক রেহমান এবং তখনকার ‘যায়যায়দিন’ কর্তৃপক্ষকে অহেতুক জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো মিডিয়া অনিয়ম করলে সেটা দেখানোর দায়িত্বও অন্য দায়িত্বশীল মিডিয়ার ওপর পড়ে। শফিক রেহমানকে আমরা যতটুকু জানি, তিনি কথার জবাব কথা দিয়ে, লেখার জবাব লেখা দিয়ে দিতেই বেশি আগ্রহী। তিনি কোনো মিডিয়াকে বন্ধ করার পক্ষে নন। মনের ভাব লেখার মাধ্যমে এবং কথার মাধ্যমে যিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রকাশ করতে পারেন, তার তো অন্যের কণ্ঠ বা কলম স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

এটা তার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী। যে কোনো ধরনের এক্সট্রিম অ্যাকশন বা চূড়ান্ত শাস্তির বিপক্ষে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বিচারিক আদালতে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডেরও বিরোধী। সারা বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের বা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে যে আওয়াজ উঠেছে, তার সাথে তিনিই প্রথম একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং এ দেশে তা জোরেসোরে প্রচার করেছেন। এই মুহূর্তে এগুলো লিখলে ‘রাজাকার’ হিসেবে গণ্য হবেন, সেই গণনা তিনি করেননি। নিজের বক্তব্য প্রকাশ করলে তাকে কোন পন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, সেই হীনম্মন্যতাতেও কখনো ভোগেন না। তার এ ধরনের অবস্থান কখনোই নৈতিক আদর্শের কোনো স্খলন বা অস্বচ্ছতায় ভোগে না। তিনি সবসময় যথেষ্ট যুক্তি ও তথ্য দিয়ে তার অবস্থান সৃষ্টি করেন।

জীবিত কোনো ‘ন্যাশনাল আইডল’ বা ‘বাস্তব নমুনা’ আমাদের সামনে নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এরূপ কাউকে আমরা তুলে ধরতে পারি না। যে দু-একজন আছেন, তাদেরও আমরা আমাদের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার কারণে ছোট বা খাটো করে ফেলি।
আমরা কাউকে হয় প্রচণ্ড ভালোবাসি কিংবা প্রচণ্ড ঘৃণা করি। এই দু’টি প্রান্তিকতার মাঝে কোনো অবস্থান আমাদের মনোজগতে ঠাঁই পায় না। বিরোধী দল কিংবা ভিন্নমতের মানুষের মাঝেও যে ভদ্রলোক থাকতে পারে, তা আমরা মেনে নিতে পারি না।

বিবিসির আকবর হোসেন গত বছরের এপ্রিল মাসে তার এক গবেষণাধর্মী নিবন্ধে প্রশ্ন রেখেছিলেন, শফিক রেহমান বিএনপির কোনো পদ-পদবিতে নেই। তার পরেও কেন তিনি বিএনপিতে এত শক্তিশালী? এই প্রশ্নটি শুধু আকবর হোসেনের একার নয়, আরো অনেকের মনেই এ প্রশ্নটি জেগেছে। এই প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হবে, শফিক রেহমান শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। একজন ব্যক্তির পদ-পদবির দরকার পড়ে, একটি প্রতিষ্ঠানের সেই প্রয়োজন নেই।

এই অবস্থান শুধু বিএনপিতে শফিক রেহমানের নয়, আওয়ামী লীগেও কেউ কেউ থাকলে বরং জাতির অনেক উপকার হতো। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগে এসে অনেকেই বিত্তশালী হয়েছেন, কেউ কেউ প্রতিপত্তিশালী হয়েছেন। কিন্তু শফিক রেহমানের মতো ‘শক্তিশালী’ বোধহয় কমই হয়েছেন। বিএনপিতে শফিক রেহমানের প্রভাব আসলেই কতটুকু, তা আমিও ভালো করে জানি না। তবে এ ধরনের একটি ভাবনা তার শত্রুমিত্র সবার মাঝে ছড়িয়ে আছে। দেশের মানুষ মনে করে, শফিক রেহমানের কোনো পরামর্শ বেগম জিয়া কিংবা বিএনপি রাখবে। অর্থাৎ জাতির ক্রান্তিলগ্নে বেগম জিয়াকে ভালো কোনো পরামর্শ দিলে তিনি হয়তোবা শুনবেন। শেখ হাসিনাকে নিয়ে এমন ধারণা করা যায় কি? কিছু দিন আগে একজন দরিদ্র ও বয়স্ক মহিলার একটি কথা ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে পড়েছিল। ওই মহিলা তার ভাষা ও ভঙ্গিতেই বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে পিটাইয়া-পুটাইয়া হলেও কোনো কথা মানানো যেত, এই মহিলারে তো কিছুই শোনানো যায় না।’

বিবিসির আকবর হোসেন বা অন্য কাউকে বিষয়টি নিয়ে আরো গভীরে অনুসন্ধান বা গবেষণার আহ্বান জানাব। এটা শুধু ব্যক্তি শফিক রেহমানকে ওপরে তুলে ধরার জন্য নয়। বরং আমাদের জাতির একটা বড় রোগ থেকে মুক্তির জন্যই এটা প্রয়োজন। প্রত্যেকটা দলেই আমাদের কিছু ‘শফিক রেহমান’ দরকার। শফিক রেহমানদের পরামর্শের একটা গুরুত্ব আছে বলেই হয়তোবা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একতরফা নির্বাচন দিয়েও পনের দিনের মাথায় পদত্যাগ করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েছিল।

আওয়ামী লীগে শফিক রেহমানের মতো কেউ নেই বলেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সৃষ্ট অবৈধ সরকারকে টেনে পাঁচ বছর পুরো করে ফেলার পথে রয়েছে। আইয়ুব খানের স্টাইলে ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নের বটিকা’ খাওয়ানোর কোশেশ চলছে। এর পরিণাম নিয়ে ভাবার বা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো কোনো শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব আওয়ামী লীগে নেই। এ ব্যাপারে যারা একটু আধটু চেষ্টা করেছেন, তারা সবাই টপ নেতৃত্বের চক্ষুশূল হয়ে ছিঁটকে পড়েছেন।

এখন আবার খায়েশ হয়েছে, ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালন করবেন। কাজেই সামনের নির্বাচন কেমন হবে তার আলামত স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। সমগ্র দেশবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বৈরশাসক এরশাদও নয় বছর টিকে ছিলেন। শাসনকে প্রলম্বিত করায় কৃতিত্বের কিছু নেই বরং একটা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের জন্য বেকুবির অনেক লক্ষণ রয়েছে এতে। এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং ভাসানী মুজিবের আওয়ামী লীগ এক নয়- এ কথাটি আজ আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে। আজকের এই তিমির রাত পোহালে নিজেদের চেহারা কিভাবে দেখাবেন, সেই চিন্তা তাদের আছে বলে মনে হয় না।

মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হওয়াকে নিজের বেকুবি বলে আফসোস করছেন। কিন্তু ভেতরে বা আশপাশে থেকে এই কিছিমের বেকুবি ধরিয়ে দেয়ার মতো অবস্থান এই মেধাবী রাজনীতিবিদও তৈরি করতে পারেননি। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের টপ নেতৃত্বের মধ্যকার এই পার্থক্য নিয়ে কোনো মুক্ত গবেষক গবেষণা করলে জাতির অনেক উপকার হবে।

আমরা অনেক সময় সঠিক কথাটি না বলে এক ধরনের False equalization এর মাধ্যমে রাজনীতির ক্রনিক রোগের চিকিৎসাকে নিজেরাই জটিল করে তুলি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি তলিয়ে দেখার জন্য একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দেশের শ্রেষ্ঠ আইনবিদদের এমিকাস কিউরি হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তাদের অধিকাংশের অভিমত ছিল তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে। কিন্তু শেষমেশ এক ব্যক্তির ইচ্ছায় এটিকে বাতিল করে জাতিকে বর্তমান দুর্দশায় ফেলে দেয়া হয়েছে।

ব্যক্তি শফিক রেহমানের গুণগান করার চেয়ে তার কর্মকাণ্ডের প্রতি একটু মনোযোগ দেয়া দরকার। কিছু দরকারি কথা নতুন প্রজন্মকে জানানো দরকার। শফিক রেহমানের বিস্তর লেখা রয়েছে। সেগুলো থেকে গবেষকরা তার ব্যাপারে অনেক গবেষণা করতে পারবেন এবং আমার এ দাবির সত্যাসত্য প্রমাণ করতে পারবেন।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত মিডিয়া এ দেশকে প্রায় ডিপলিটিসাইজেশন বা বিরাজনীতিকরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাদের আসল চেহারাটি দেখা গেছে এক এগারোর সময়। তারা নানা কৌশলে সৎ ও চরিত্রবান রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন করে গেছেন, মেধাবী ও তরুণ অংশকে রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ করেছেন।

বাকশালের মতো ভুল পরামর্শ দিয়ে তারা দেশের রাজনীতিকে যে বিভ্রান্তি ও জটিলতায় জড়িয়েছিলেন, সেখান থেকে আজো জাতির মুক্তি মিলছে না। বরং আরো নতুনভাবে জড়ানো হচ্ছে। ভালো ও সৎ মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন- এ ধরনের সর্বনাশা প্রচারণা জাতিকে স্থায়ী পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা সবাই চাই, দেশটি ভালোভাবে চলুক। কিন্তু এ জন্য যে ভালো চালকের দরকার, এ কথাটি আমরা ভুলে যাই।

আমার অনেক বন্ধুবান্ধব বিষয়টি নিয়ে আমাকেও একই প্রশ্ন করেন, আরো নিরপেক্ষ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ এটা নিয়ে আফসোসও করেন। আমার এসব হিতাকাক্সক্ষী বন্ধুর অনেকেই বিদেশের মাটিতে থাকেন। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে সেসব দেশে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব পেয়েও তারা খুশি। কারণ সে সব দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আছে, আইনের শাসন আছে। মানুষের মানবিক মর্যাদা ও মানবিক স্বস্তির সব উপায় উপকরণ তাদের আয়ত্তে চলে এসেছে। কিন্তু এসব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদ কিভাবে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে আমার এসব ট্যালেন্টেড বন্ধুরা খুব কম ভাবেন। বস্তুনিষ্ঠতা বাদ দিয়ে সবাই যদি নিরপেক্ষতার পেছনে ছুটতেন, তবে বর্তমান সৌভাগ্য তাদের কখনোই ধরা দিত না।

এসব উন্নত দেশের প্রায় সবগুলোতেই কনজার্ভেটিভ ও লিবারেল নামক দু’টি দল আছে। দেশের ভালো, ভদ্র ও বিবেকবান মানুষগুলোই এসব দলে যোগ দেন। তারা পক্ষের মানুষগুলোকে ভালো বানাতে চেষ্টা করেন। আমাদের মতো নিরপেক্ষ মানুষগুলোকে ভালো করার চেষ্টা করেন না। আমাদের এই ভুল চিন্তার কারণে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। তারা ওদের শুদ্ধ চিন্তার জন্য এগিয়ে গেছেন।

কাজেই ডায়াবেটিস আক্রান্ত এই দেশের রাজনীতি ও মিডিয়াকে ঠিক করতে আরো বেশি ‘শফিক রেহমান’ দরকার।

Exit mobile version