সিরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। এটি ইউক্রেন ও গাজার সংকট থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে।
অনেক বিশ্লেষক সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে ২০২১ সালের আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনা করছেন। যদিও দুই দেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা ভিন্ন, তবে দেশ দুটির মধ্যে আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিদেশি হস্তক্ষেপ, শাসনব্যবস্থা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, রাজনৈতিক বৈচিত্র্য, লিঙ্গনীতি ও আন্তর্জাতিক বৈধতার মতো বেশ কিছু বিষয়ে মিল রয়েছে।
সিরিয়ার সংকটের মূল ১৯৮০-এর দশকে। ১৯৮২ সালে হাফেজ আল-আসাদের সরকার দেশটির হামায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার সুন্নি নাগরিককে হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই অঞ্চলে এটিই ছিল প্রথম রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা।
২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় কয়েকজন সুন্নি কিশোরকে হত্যা করার ঘটনায় সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এর জেরে আসাদ সরকার ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছিল, বহু মানুষকে হত্যা ও কারাবন্দী করেছিল এবং লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছিল।
সম্প্রতি হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) অগ্রযাত্রা ও বাশার আল-আসাদের পতন অনেকটা তালেবানের কাবুল দখলের মতো দ্রুত ঘটেছে। দামেস্ক পতনের ঘটনাকে ১৯৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে নাজিবুল্লাহ সরকারের পতনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
এইচটিএস আদর্শিকভাবে মুজাহিদীন গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে আসাদের বাথ পার্টির শাসন আফগানিস্তানের সাবেক কমিউনিস্ট সরকারের মতোই ছিল। তালেবান যেভাবে ক্ষমতা নিয়ে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছিল, একইভাবে এইচটিএস ক্ষমতা নেওয়ার পর সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য এখনো তা কার্যকর হয়নি।
তালেবান ও হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) আদর্শিক ভিত্তি ভিন্ন ইসলামি ধারায় প্রতিষ্ঠিত। তালেবানের মতাদর্শ দেওবন্দি মাদ্রাসাভিত্তিক, যা কিনা ইসলামকে রক্ষণশীল ও ঐতিহ্যবাহীভাবে ব্যাখ্যা করে। অন্যদিকে এইচটিএসের মতাদর্শ কোনো সময়েই মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। বরং সংগঠনটি আল–কায়েদা থেকে একটি অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী অবস্থানে এসেছে।
এমনকি ব্রাদারহুড নেতারা এ কারণে হতাশ যে এইচটিএস নেতা আহমদ আল-শারা তাদের প্রভাব থেকে সংগঠনটিকে দূরে রেখেছেন।
সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা এবং ২০০৩ সালের পর ইরাক আগ্রাসনের দিকে মনোযোগ দেওয়া আল–কায়েদার মধ্যেই মূলত এইচটিএসের শিকড় প্রোথিত। অন্যদিকে তালেবানের নেতৃত্ব মূলত সেই মুজাহিদিন ও জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর মধ্য থেকে উঠে এসেছে, যারা সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিল।
‘তালেবান’ শব্দের অর্থ ‘ছাত্ররা’, যা তাদের দেওবন্দি মাদ্রাসা-সংযোগের ইঙ্গিত দেয়। মুজাহিদিনদের বিজয়ের পর ১৯৯০-এর দশকে শাসনব্যবস্থা, নৈরাজ্য এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে তালেবানের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়। তালেবান মূলত দেওবন্দি মতাদর্শে গঠিত হলেও জিহাদি গোষ্ঠীগুলো মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল।
এইচটিএস তুলনামূলকভাবে নারীদের অধিকারে নমনীয় অবস্থান দেখিয়েছে। তাদের সরকারে নারীরা মন্ত্রিসভা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে ভূমিকা রাখছে। বিপরীতে, তালেবান নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সাংস্কৃতিকভাবেও তাদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। এইচটিএসের নেতারা পশ্চিমা পোশাক পরলেও তালেবান ঐতিহ্যবাহী আফগান বা পাকিস্তানি পোশাক পরায় অনড়।
সিরিয়া কিছুটা অভ্যন্তরীণ স্বীকৃতি পেলেও নির্বাচন না হলে তা নষ্ট হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে তারা পুনরায় স্বীকৃতি পেতে চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান অভ্যন্তরীণ সংকট ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাবে ভুগছে। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ ও সাংবিধানিক শূন্যতা তালেবান সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আফগানিস্তান ও সিরিয়ার রাজনৈতিক পথ আলাদা। আফগানিস্তান ঐতিহ্যগতভাবে সুন্নি-হানাফি মুসলমানদের দ্বারা শাসিত। অন্যদিকে সিরিয়া শিয়া সম্প্রদায়ের আলাওয়ি গোষ্ঠীশাসিত ছিল। তারা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। এখন সিরিয়ায় সুন্নি-হানাফি মুসলমানদের উত্থান ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের শাসনের সঙ্গে সিরিয়ার শাসনের সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তবে এর স্থায়িত্ব অনিশ্চিত।
জাতিগত গঠনের দিক থেকেও এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সিরিয়ায় প্রধানত আরব, তুর্কি ও কুর্দিরা বসবাস করে। আর আফগানিস্তানে পশতুন, তাজিক, হাজারা ও উজবেকরা মিলেমিশে বসবাস করে।
উভয় দেশেই কার্যকর রাজনৈতিক দল নেই। এইচটিএস চার বছরের মধ্যে নির্বাচন অসম্ভব বলছে। আর তালেবান সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছে।
সিরিয়া কিছুটা অভ্যন্তরীণ স্বীকৃতি পেলেও নির্বাচন না হলে তা নষ্ট হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে তারা পুনরায় স্বীকৃতি পেতে চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান অভ্যন্তরীণ সংকট ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাবে ভুগছে। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ ও সাংবিধানিক শূন্যতা তালেবান সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এইচটিএস ও তালেবানের পতাকা তাদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। উভয়ের পতাকায় সাদা রঙের পটভূমিতে আরবি হরফে কলেমা লেখা থাকলেও এইচটিএসের পাশাপাশি সিরীয় বিরোধী আন্দোলনের আরেকটি পতাকা ব্যবহার করে। এটি এইচটিএসের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তালেবানের সঙ্গে তাদের পার্থক্য নির্দেশ করে।
এইচটিএস–শাসিত সিরিয়া পশ্চিমা শক্তিগুলোর দিকে ঝুঁকেছে। বিশেষ করে তারা তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অনিশ্চয়তার কারণে এই সম্পর্ক এখনো দৃঢ় হয়নি।
সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের সঙ্গে তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশগুলো ও জর্ডানের ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তারা অর্থনৈতিক সহায়তা ও পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইসরায়েল যদিও সিরিয়ায় বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সিরিয়ার কিছু অঞ্চল দখল করে রেখেছে, তবু এইচটিএস সরকারের বিষয়ে ইসরায়েলের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
এইচটিএস নেতা নতুন শাসনের শুরুতেই ইরানকে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে সতর্ক করে দিলেও অন্য দেশগুলোর বিষয়ে তিনি নির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি।
অন্যদিকে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক মূলত সহযোগিতামূলক, তবে সতর্কতামূলক। পাকিস্তান বিশেষভাবে হতাশ। কারণ, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আফগানিস্তানে অবস্থান করছে। অন্য প্রতিবেশী দেশগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে, বড় প্রকল্প যেমন খনি ও বাঁধ নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে। এটি ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাবুল ত্যাগের ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণে ভূমিকা রাখছে।
আঞ্চলিক সম্পর্কেও দুই দেশের পার্থক্য রয়েছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ডুরান্ড লাইন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং ইরানের সঙ্গে পানিসম্পদ নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে সিরিয়া ও তুরস্ক অতীতের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। তবে ইরানের সঙ্গে সিরিয়ার নতুন সরকারের আদর্শিক ও সাম্প্রদায়িক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ উভয় দেশেই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। আফগানিস্তানে প্রচুর খনিজ সম্পদ ও পানির মজুত আছে। সিরিয়ায় রয়েছে তেল ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এ ছাড়া দুই দেশেই তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি।
সিরিয়া ও আফগানিস্তান দীর্ঘদিনের সংঘাতে বিধ্বস্ত। যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ও বিভক্ত সমাজ তাদের সাধারণ চ্যালেঞ্জ। স্থায়ী শান্তি ও উন্নতির জন্য উভয় জায়গায় ব্যাপক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন।
- সায়েদ ইয়াকুব এমাদ আফগান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ