বেসিক ব্যাংক বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না। তারা কোনো সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায়। এ কথা জানিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে।
এর আগে ৯ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বলেছিলেন, তাঁরা বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চান না। বেসিক ব্যাংক শতভাগ রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক। সরকারি এই ব্যাংককে বেসরকারি একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার খবরে তাঁরা ‘আতঙ্কগ্রস্ত’।
বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্তে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছেন বেসিক ব্যাংকের আমানতকারীরা। তাঁদের কেউ কেউ বেসিক ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিতে শুরু করেছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই আমানত বেশি সরিয়ে নিচ্ছে।
বেসিক ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে পাঁচ কার্যদিবসে ব্যাংকটি থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে। আমানত তুলে নিতে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটিকে চিঠি দিয়েছে। এতে তীব্র তারল্যসংকটে পড়েছে ব্যাংকটি। এর ফলে বেসিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে পারছে না।
বেসিক ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা কমে এখন ১২ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণ ছিল ১২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশ।
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) এ এম মোফাজ্জেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে সোনালী, জনতার মতো আমরাও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক। এ কারণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা আমাদের ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছে। বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার খবরে তারা টাকা তুলে নিতে শুরু করেছে।’ তিনি বলেন, এ জন্যই সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার জন্য সরকারের কাছে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ।
দুই চিঠি
বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সরকারের কাছে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নেয় গত বুধবার। এরপরই চিঠি দেওয়া হয়। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক একটি গণমাধ্যমকে বলেন, বেসিক ব্যাংক সরকারি ব্যাংক নয়।
বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ব্যাংক বিবেচনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকটিতে টাকা রেখেছিল। ব্যাংকটির আমানতের বড় অংশ এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে। যখন বলা হলো এটি সরকারি ব্যাংক নয় এবং বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা সরিয়ে নিতে শুরু করে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে তারা অনেকে টাকা তুলে নেয়।
এমন পরিস্থিতিতে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে দুটি চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। এর একটিতে বলা হয়, বেসিক ব্যাংক শতভাগ সরকারি ব্যাংক। তাই বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা ঠিক হবে না। একীভূত করতে হলে সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা উচিত।
আরেকটি চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক একীভূত করার খবরে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ জন্য সরকারের সহায়তা চেয়েছে ব্যাংকটি।
চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছেও। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকটির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত তুলে নিচ্ছে। এ জন্যই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত পাঁচটি ব্যাংককে অন্য পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য বলেছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিডিবিএল সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে। সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে শুধু এক্সিম ব্যাংক ‘অন্য ব্যাংককে নেওয়া এড়াতে’ আগেই পদ্মা ব্যাংককে বেছে নিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। ব্যাংকগুলো নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিনকে ডেকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সংকটে থাকা রাষ্ট্র খাতের বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের এ সময় উপস্থিত ছিলেন। দুই পক্ষের কেউই ‘চাপিয়ে দেওয়ার’ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেননি।
একসময়ের ভালো ব্যাংক বেসিক
শতভাগ রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবেই পরিচিত ছিল। এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু ১৯৮৯ সালে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান থাকতেন শিল্পসচিব। এই চর্চা ভেঙে দেওয়া হয় ২০০৯ সালে। চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় বেসরকারি খাত থেকে। জাতীয় পার্টির আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়, যা কার্যকর হয় ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর। দুই দফায় পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। এই পাঁচ বছরে ব্যাংকটিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে নামিয়ে এনে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই পদত্যাগ করেন তিনি।
আবদুল হাই চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই ব্যাংকটির ঋণ বাড়তে থাকে। ব্যাংকিং নিয়মকানুন এড়িয়ে একক কর্তৃত্ববলে তিনি বড় আকারের ঋণ দেওয়া শুরু করেন। বুঝেশুনে ঋণ দেওয়া এ ব্যাংকের খেলাপি হার সব সময় থাকত ৫ শতাংশের নিচে। পাঁচ বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ওঠে ৬৮ শতাংশে।
আবদুল হাই শুধু ঋণ দেওয়ার মধ্যেই আটকে ছিলেন না। কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়া তিনি অবাধে জনবলও নিয়োগ দেন। ২০০৯ সালে ব্যাংকটির জনবল ছিল ৭৭৬ জন, ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এখনো জনবল ২ হাজারের বেশি। জনবল বেশি হওয়ায় অপরিকল্পিত বিভিন্ন স্থানে শাখা খোলা হয়।
বিগত ১০ বছরে বেসিক ব্যাংক লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। অনিয়মও হয়েছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার। ফলে বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির সমপরিমাণ লোকসান হয় গত ১০ বছরে।
বেসিক ব্যাংকের এই পরিণতির জন্য শেখ আবদুল হাইকে দায়ী করা হলেও তাঁকে অভিযুক্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে ঘটনার এক যুগ পর। যদিও তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গ্রেপ্তার করার দৃশ্যমান উদ্যোগও নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সিটি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক চাপে পড়ে একীভূত হতে চলছে, এটা এখন প্রমাণিত। সারা বিশ্বে ব্যাংক একীভূত করা হয় উভয় পক্ষের ইচ্ছাতে, যাতে নিজেরা শক্তিশালী হতে পারে। বাংলাদেশেই দেখা গেল উল্টো প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে। এমন অবাস্তব, অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ফলে দুর্বল বেসিক আরও দুর্বল হচ্ছে। আমানতকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছেন।
মুস্তফা কে মুজেরি আরও বলেন, নিয়মের মধ্যে ব্যাংক একীভূত করতে হবে। না হলে সংক্রামক ব্যাধির মতো বেসিকের প্রভাব অন্য ব্যাংকগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।