- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৪ জুলাই ২০২০
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয় বরং সরকারের সর্বত্রই সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এক বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, সারাক্ষণ আতঙ্কে কাটে আপনাদের দিন-রাত। চারদিকে আপনাদের অপকর্মের স্তুপ এতো বিকট আকার ধারণ করেছে যে, বিএনপিকে গালমন্দ করা ছাড়া এই মুহুর্তে আপনাদের স্টকে আর কিছু নেই। তাই প্রলাপ বকেন আর বিএনপিকে নিয়ে সমালোচনা করেন। আসলে সারাবিশ্বে এখন আলোচিত দুর্নীতিবাজ সরকার হলো ভোট ডাকাতির মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী আওয়ামী লীগ। যত অপকর্ম করছে আওয়ামী লীগ আর জনরোষের ভয় দেখাচ্ছেন বিএনপিকে। কি হাস্যকর কথা! যদি সৎ সাহস থাকে তবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। তখন দেখা যাবে কারা জনরোষে পড়ে। শুক্রবার দুপুরে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে রিজভী এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, হুমকি-ধামকি, হামলা-মামলা, জেল-জুলুমের ভয় উপেক্ষা করেও আমরা অব্যাহতভাবে সরকারের অনিয়ম দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করছি, অনিয়মগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। কোভিড-১৯ যেহেতু একাধারে একটি বৈশ্বিক সংকট এবং এটি একটি জাতীয় সংকটও, সুতরাং পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে সব ধরণের সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলাম। এমনকি আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, গত ২২ মে স্পষ্ট করেই সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখিয়ে নিজেদের কাগুজে সাফল্য দেখানোর চেয়ে বেশি জরুরী করোনা ভাইরাস টেস্ট নিয়ে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন। কারণ, করোনা ভাইরাস টেস্টের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে ভবিষ্যতে নাগরিকদেরকে অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হতে পারে’। কিন্তু এই সরকার কোনো কথাই কানে নেয়ার চেষ্টা করছেনা অথবা শুনেও না শোনার ভান করছে। বরং আমরা দেখছি, সরকারের একটাই কাজ, কারণে অকারণে শুধু বিএনপির বিরোধিতা করা।
রিজভী বলেন, সকলেই দেখছেন নিজের বাসার ড্রয়িংরুমে বসে প্রতিদিনের মতো গতকালও ভিডিও কনফারেন্সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি এখন মানসিকভাবে বিপন্ন। বিএনপি নিজেরাই জনরোষের ভয়ে আতঙ্কে আছে। তারা জনগণকে সাহস না দিয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। করোনার বেপরোয়া চালকের মতো তারা রাজনীতিতেও বেপরোয়া আচরণ করছে।’ তার এই কথার জবাব দিয়ে তার গুরুত্ব বাড়ানোর দরকার আছে বলে বিএনপি মনে করেনা। তার এই কথায় প্রতিয়মান হয় যে, সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতা আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি-লুটপাটে বেসামাল মিডনাইট সরকার দেশে-বিদেশে বিতর্কিত হয়ে পড়ায় অস্থির হয়ে পড়েছে। তাদের চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। নিজেদের আয়নায় এখন কেবল জনগনের দল বিএনপিকে কল্পনা করছেন তারা। কাদের সাহেবের কথাটা হবে আওয়ামীলীগ জনরোষের আতঙ্কে আছে।” কিন্তু তিনি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে ফেলেছেন কথাটা।
নিজেদের অবস্থাটা এখন অন্যের ভিতরে দেখতে চাচ্ছেন। অনুভব বা অনুমান করছেন যে, তাদের কি ভয়াবহ অবস্থা।
তিনি বলেন, আর বিএনপি আতঙ্কিত হবে কেনো? বিএনপি কি চাল চুরি, তেল চুরি, ত্রাণ চুরি, করোনার টেস্ট কিট দুর্নীতি, ব্যাংক লোপাট, রাজকোষ চুরি, শেয়ার বাজার লুন্ঠন, রাতের অন্ধকারে জনগনের ভোট ডাকাতির কাজে লিপ্ত ছিল কি? দেশব্যাপি উল্লেখিত চুরি ও ডাকাতি ও লুটের সাথে আপনাদের জড়িত থাকাটা শুধু দেশিয় গণমাধ্যম না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচার হচ্ছে। সুতরাং জনরোষের ভয়ংকর আতংকের মধ্যে আপনারা এখন প্রলাপ বকছেন।
রিজভী বলেন, বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেই একযুগ। গণতন্ত্র হত্যা করে, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নানা অপকৌশলে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, বিএনপিকে দুর্বল করতে বছরের পর বছর ধরে সরকার রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিএনপির শত শত নেতাকর্মীকে গুম-খুন অপহরণ করা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সারাদেশে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে র্যাব পুলিশকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। এতো কিছু করার পরও বিএনপিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। আর যায়নি বলেই, ওবায়দুল কাদের কিংবা হাসান মাহমুদদেরকে প্রতিদিন নিয়ম করে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে হলেও জনগণের সামনে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়।
তিনি বলেন, গত এপ্রিল ওবায়দুল কাদের করোনা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মনিটর করছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন, তদারকি করছেন’। জনগণ জানতে চায়, প্রধানমন্ত্রী যদি করোনা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটর করেন তাহলে ভুয়া প্রতিষ্ঠান ‘জেকেজি হেলথ কেয়ার এবং রিজেন্ট হসপিটাল’ করোনা ‘টেস্ট ও ট্রিটমেন্টে’র অনুমতি পেলো কেমন করে? এরপর দেখা গেছে, এইসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান কেমন করে করোনা ‘টেস্ট ও ট্রিটমেন্টে’র অনুমতি পেয়েছে সেটি নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেই নতুন নাটক জন্ম দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে ‘জেকেজি এবং রিজেন্ট’ কাজ পেয়েছে। অপরদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা কিছুই জানেনা। মরণঘাতী করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যখন সারাবিশ্বে এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে কাজ করছে, তখন এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে নেয়া সিদ্ধান্ত সম্পর্কে, প্রধানমন্ত্রী জানেন না, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেন না তাহলে জানবেটা কে? কার জানা উচিত? জনগণের প্রশ্ন, দেশটা আসলে চালায় কে?
তিনি বলেন, আরো আর্শ্চযের বিষয় হলো- এই দুই ভুয়া প্রতিষ্ঠান, প্রকাশ্যেই অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে করোনা সার্টিফিকেট ইস্যু করার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে। সরকার দেখেও না দেখার ভান করেছিল। কিন্তু যখন দেখা গেলো, টাকার বিনিময়ে এই দুই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ইস্যু করা ‘করোনা নেগেটিভে’র ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যাত্রীরা ঢুকতে পারছেনা, তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে, বাংলাদেশের যাত্রীরা ‘ভাইরাস বোমা’ হিসেবে অভিহিত হচ্ছে তখন এই নিশিরাতের সরকারের টনক নড়েছে। ততক্ষনে বাংলাদেশের ক্ষতি যা হওয়ার তার অনেকটাই হয়ে গেছে।
রিজভী বলেন, এই সরকারের দুর্নীতি অব্যবস্থাপনার কারণে যখন দেশে রাজস্ব আয়ের নানা ক্ষেত্র সংকুচিত, তখনো রাষ্ট্রের অন্যতম একটি গুরুত্বপুর্ণ রাজস্ব খাত ছিল রেমিটেন্স। এই রেমিটেন্সের ওপর ভর করেই প্রায়শই সরকারকে বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। অথচ, নিশিরাতের সরকারের অদক্ষতা, অদূরদর্শিতায় করোনা ভাইরাস টেস্ট নিয়ে কেলেঙ্কারির কারণে রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত সেই প্রবাসী বাংলাদেশিরাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। ইতালি এবং মধ্যপ্রাচের অনেক দেশেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঢুকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে যেমন সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে পাশাপাশি যারা রয়েছে তাদেরকেও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, করোনা সংকটের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুরাবস্থা জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই নয়, প্রতিটি মন্ত্রণালয়, প্রতিটি সংস্থা, সবখানেই দুর্নীতি অনাচার অনিয়ম। এই অবস্থায় দুই একজনকে গ্রেফতার, বদলি কিংবা পদত্যাগ করিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমনকি দুই একটা মন্ত্রণালয়ে রদবদল করেও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। অপ্রিয় সত্য হলো, নিশিরাতের ষড়যন্ত্রে যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলো তাদের মধ্যে থেকে ‘এধার কি মাল ওধার মে ঢাল’ কিংবা ‘চোরে চোরে মাসতুতো’ ভাইদের দিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নের আশা করে লাভ নেই। কারণ এই ‘মাসতুতো’ ভাইরা জানে তাদের ‘অবস্থা-অবস্থান-উত্থান’ সবটাই ঘটেছে ‘দুর্নীতির প্রক্রিয়া, দুর্নীতিবাজদের মাধ্যমে, দুর্নীতিবাজদের দ্বারা’। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চাইলে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় গোটা সরকারেরই খোলনলচে পাল্টাতে হবে। অর্থাৎ প্রধামন্ত্রীসহ এই সরকারের পদত্যাগ করতে হবে।
রিজভী আরো বলেন, জনগণের কাছে এখন স্পষ্ট, এই সরকারের উদ্দেশ্য জনস্বার্থ নয়, এই উদ্দেশ্য জনগণের অর্থ সম্পদ লুটপাট ও টাকা পাচার। এই সরকারের আমলে তাই দেশের ব্যাংকগুলো প্রায় দেউলিয়া অথচ বিদেশের ব্যাংকে জমছে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকা। আপনারা সুইস ব্যাংক প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখেছেন, ২০১৯ সালে শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার পরিমান দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। কারা এসব টাকার মালিক? এতো টাকা কেমন করে সেখানে পাচার হলো? কিভাবে হলো? টাকা পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি এইসব টাকা ফেরত এনে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করা গেলে এই করোনাকালে মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হতোনা। এই সরকারের গত একদশকে দেশ থেকে নয় লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। রাষ্ট্রের আনুকুলেই এই অর্থলোপাট ও পাচারের কাজগুলো হয়েছে। এইসব টাকা থাকলে সরকারকে এখন দেশের রিজার্ভের টাকার দিকে নজর দিতে হতোনা। কেবল পাচার-ই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় লুটেরারা গড়ে তুলেছে সেকেন্ড হোম। বেড়েই চলছে কানাডার বেগম পাড়ার পরিধি।