ঢাকা
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন ব্যবসায়ীর কর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে বিশেষ তদন্ত কার্যক্রম চালু করেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ওই পাঁচ ব্যবসায়ী হলেন বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম এবং নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিআইসি থেকে ওই পাঁচ ব্যবসায়ী ও তাঁদের সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানতে চেয়ে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সঞ্চয় অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের হিসাবের যাবতীয় তথ্য সিআইসির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
ওই পাঁচজন ব্যবসায়ী পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সালমান এফ রহমান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা। অভিযোগ রয়েছে, ওই পাঁচ ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠান সাবেক সরকারের আমলে নানা ধরনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল এখন খতিয়ে দেখবে, তাঁদের প্রকৃত আয় ও ব্যয় কত; কর নথিতে সব সম্পদ দেখানো আছে কি না এবং আয় অনুসারে তাঁরা কর দিয়েছেন কি না।
জানা গেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত, এমন সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে গত বুধবার বিকেলে সিআইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। বৈঠকে বিভিন্ন পন্থায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির বিশেষ অনুসন্ধান শুরু করার জন্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে যাঁদের সন্দেহ করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনা ও সুনির্দিষ্ট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সিআইসি তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল শীর্ষ এই পাঁচ ব্যবসায়ী ও তাঁদের নিকটজনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করা হয়। পাশাপাশি তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয়ও পর্যালোচনা করা হবে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। পর্যায়ক্রমে অন্য সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী করদাতাদের কর ফাঁকিও তদন্ত করা হবে।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এনবিআরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের আয়কর আইন ও ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে না দেওয়া কর উদ্ধারের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তদন্তের আওতায় থাকা বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। বক্তব্য জানতে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে মুঠোফোনে কল দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি। বাকি তিনজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তাঁদেরকে দেশের কোথাও জনসমক্ষে দেখা যায়নি।
কর ফাঁকির এই তদন্তের বিষয়ে এনবিআরের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে সন্দেহভাজন করদাতাদের আয়-ব্যয়ের তথ্য যাচাই–বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা সব করদাতার জন্য একটি সমতলভূমি (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরি করতে চাই, যাতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত না হন। কর ফাঁকি দিয়ে কেউ পার পাবে না।’
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রীসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও তলব করা হয়েছে। এবার একসঙ্গে পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর কর ফাঁকি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এর আগে গত সপ্তাহে কর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে দেশের আরেক শীর্ষ ব্যবসায়ী এস আলম (সাইফুল আলম) ও স্ত্রী, সন্তানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে আয়কর বিভাগের কর অঞ্চল-১৫। এ ছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট থেকে এস আলম গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি তদন্ত করা হচ্ছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার লেনদেনসহ যাবতীয় বিষয় নিরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।