সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে, মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে!

logo

আলী রীয়াজ

(১ সপ্তাহ আগে) ১৬ নভেম্বর ২০২২, বুধবার

বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ২৩৩ ডলার বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে পৌঁছেছে সরকারের দেয়া এই তথ্যকে আপনি তিনভাবে দেখতে পারেন –

১। এটা একটা তৈরি করা হিসেব, এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। ফাঁকিঝুঁকি, গড়মিল এইসব করে একটা সংখ্যা তৈরি করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের ডলার রিজার্ভের হিসেবের মতো, সরকারের কাছে আইএমএফ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের হিসেব চাইলে দেখা গেলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বললেন আছে মাত্র ২৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ জ্ঞানীজনেরা নির্বোধ বাংলাদেশিদেরকে রিজার্ভের হিসেব দেখিয়ে বলছেন এখনও ৩৫ বিলিয়ন ডলার আছে। এখন বাতাসে ভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে – রিজার্ভের পরিমাণ সম্ভবত আরও কম। বাতাসের কথা সত্যি না মিথ্যা তা বোঝার উপায় নেই কেননা প্রকৃত হিসেব দেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। রিজার্ভের আকাশচুম্বী পরিমাণ, সারা দেশে বিদ্যুতের বন্যা বইয়ে দেয়া, উন্নয়নের জয়ডঙ্কার মতো এই হিসেবেও আপনার কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে। যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেও নিশ্চিত না ‘দুর্ভিক্ষ’’ হবে কি হবেনা, যখন সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে – সেই সময়ে মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে কীভাবে সেই প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন। আর সেই উত্তর না পেলে আপনাকে এই উপসংহারে পৌছুতে হবে – এই অংক বানানো।

২।

মাথাপিছু আয় অবশ্যই বেড়েছে। সবার বাড়েনি – কেননা এই হিসেব গড় আয়ের। ফলে আপনার- আপনার পরিবারের, বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজনের বাড়েনি মানে এই নয় যে আয় বাড়েনি। আপনি না হয় ওএমএস এর লাইনে জায়গা খুঁজছেন, আপনার পরিচিতজন না হয় খাবারের পরিমাণ কমাচ্ছে, কিন্ত অন্য কারো বেড়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যখন অধিকাংশের আয় কমছে তখন খুব স্বল্প সংখ্যকের আয় বাড়ছে; এই বৃদ্ধি যৎসামান্য নয় – এতটাই যে সারা দেশের ১৮ কোটি মানুষকে টেনে তুলছে। তাঁরা সংখ্যায় কম – তার মানে বুঝতে পারছেন? তার অর্থ হল বৈষম্য বাড়ছে – ভয়াবহ ভাবেই বাড়ছে। যাদের আয় বাড়ছে তাঁরা কারা? এই সময়ে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়  না পেয়ে এই বৃদ্ধি যে সম্ভব না তা বুঝতে রকেট-বিজ্ঞানী হতে হয় না। চারিদিকে যখন সংকটের কথা, যখন সরকার এইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যদের কাছে ঋণ চাইছে এই বলে যে না হয় সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়বে সেই সময়ে মাথাপিছু আয় বাড়া মানুষগুলো কারা? কী ধরণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল থাকলে এই রকম ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়াকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া হয়।

৩। সরকার বলেছে অতএব এটা ধ্রুব সত্য। আমাদের মেনে নিতেই হবে। আপনার চারপাশে কী ঘটলো তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই – সরকারে আস্থা রাখুন। শুধু তাই নয়, এখনই এই কথা প্রচারের জন্যে ঢোল জোগাড় করুন, না পারলে সামাজিক মাধ্যমে দুই বাক্য লিখুন – এতে আপনি কত গর্বিত। (কিন্ত বাজারে যাবেন না, সেখানে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া)।

[লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া।]