সাগর থেকে সবশেষ গ্যাস এসেছে ১১ বছর আগে; এর আগে ও পরে শুধু সম্ভাবনা আর কথার ফুলঝুরি চললেও নতুন করে কাজের কাজ কিছু হয়নি। তবে আবার অনুসন্ধান শুরুর উদ্যোগ এবার এগোচ্ছে, যা নিস্ফলা সেই সময়কে পেছনে ফেলে দিতে পারবে কি না তা জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও কিছু দিন।
দীর্ঘ সময় অপচয় করে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের এ প্রক্রিয়া শুরু করে যাওয়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তা থেমে থাকেনি। সরকারের পালাবদলের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার কাজটিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
আশা করছে এবার তারা অধরা থেকে যাওয়া সমুদ্রের ‘সুনীল অর্থনীতির’ সোনালী দিগন্তের একটা অংশ উন্মোচন করতে পারবে।
এ দফায় দেরি না করে অনুসন্ধান কাজের জন্য তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস খোঁজার সেই কাজের প্রথমভাগের অংশ হিসেবে অনুসন্ধানকারী কোম্পানি নির্বাচন প্রক্রিয়ার এক ধাপ প্রায় শেষের কাছে এসে পৌঁছেছে। আমেরিকার দুটি বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি এশিয়ার পাঁচটি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি এখন পর্যন্ত আগ্রহ দেখিয়েছে। বাস্তবে এসব কোম্পানির আগ্রহ কতটুকু তা সুস্পষ্ট হবে সোমবার।
এদিন এসব কোম্পানির একটি ভালো সাড়া আশা করছেন সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র ‘অফশোর বিডিং’ আহ্বানকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
এদিন বেলা ১টায় অফশোর বিডিংয়ের দরপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হচ্ছে; যাতে অংশ নিতে দরপত্রের কাগজপত্র সংগ্রহ করেছিল সাতটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি। নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর শুরু হবে দরপত্র পর্যালোচনা।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাতটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি যেসব প্রস্তাব জমা দেবে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের এ ধাপে পৌঁছাতেও অনেক চড়াই উৎরাই পেরোতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ২০১৯ সালে আগের দফার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পাঁচ বছর পর এ বছর মার্চে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৯টি অগভীর ও ১৫টি গভীরসহ সমুদ্রদের মোট ২৪টি ব্লক ইজারা দিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়; যেজন্য শেষ সময় বেঁধে দেওয়া হয় ৯ সেপ্টেম্বর।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর এসময় আরও তিন মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর করা হয়। এতে অংশ নিতে শেষ পর্যন্ত সাতটি কোম্পানি দরপত্রের শিডিউল সংগ্রহ করে।
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নাম লেখানো অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এবার মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল বঙ্গোপসগারে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আছে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানকারী যুক্তরাষ্ট্রের আরেক কোম্পানি শেভরন।
বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের অভিজ্ঞ সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি, বঙ্গোপসাগরের অগভীর অংশে দুটি ব্লকে (ব্লক এসএস-৪ ও এসএস-৯) আগে থেকেই অনুসন্ধান কাজে যুক্ত থাকা ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি দরপত্র সংগ্রহ করেছে।
নতুন করে এ খাতে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে ইনপেক্স জাপান, থাইল্যান্ডের পিটিটিইপি ও চীনের সিএনওওসি।
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা এখন অপেক্ষায় আছে আগ্রহ দেখানো কোম্পানিগুলো কতটুকু সাড়া দেবে সেদিকে।
কর্মকর্তারা বলেন, ১০ হাজার ডলার খরচ করে দরপত্রের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে কোম্পানিগুলো। শেষ পর্যন্ত তারা অংশ নিলেই বোঝা যাবে বাস্তবে তাদের আগ্রহ কতটুকু।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় হলেও ইতোপূর্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে এবারের পরিস্থিতি কী হয় তা ৯ ডিসেম্বরের পরে বলা যাবে।
তার মতে, এবারের মডেল পিএসসি আগের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হওয়ায় সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হতে পারে। একটা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা যেতে পারে।
‘‘তবুও যেহেতু এটা ব্যাপক বিনিয়োগের একটি বিষয় তাই চূড়ান্ত ঠিকাদারি কোম্পানিই নেবে।”
‘এবার বিলম্ব হবে না’
বঙ্গোপসাগরে ১৯৯৬ সালে আবিষ্কার হওয়া সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ১৫ বছর পর ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে সাগরের আর কোনো গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়নি।
সাঙ্গুর গ্যাস শেষ হয়ে আসছে এমন আলোচনার মধ্যেই সম্ভাবনাময় গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস খনিজ অনুসন্ধানের নানান আলোচনা ও উদ্যোগ চলতে থাকে। তবে এখনও সেগুলো বাস্তবরূপ পায়নি। যে কারণে অগভীর বা গভীর কোনো ব্লক থেকেই গ্যাস যোগ হচ্ছে না।
সমুদ্রের বাংলাদেশ অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং ১১টি অগভীর সমুদ্রে।
মাঝের বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানান কারণে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে শুধু দুটি ব্লকে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি। ২০১৪ সালে অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে কোম্পানিটির সঙ্গে দুটি উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) সই করে পেট্রোবাংলা। তবে এখনও সেই কাজ চলমান।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরের ১২ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার পসকো দাইয়ুর সঙ্গে পিএসসি হয়। তবে গ্যাস থাকার পরও অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্তোসের পর তারাও বাংলাদেশ ছেড়ে যায়।
সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের এমন চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্যে এবার কাজ দ্রুত গতিতে এগোনোর ওপর জোর দিচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”এবারের বিডিং প্রসেসকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু এবার কতগুলো কোম্পানি এগিয়ে আসে এবং তাদের প্রস্তাবে কী থাকে, বিশ্লেষণে কী পাওয়া যায় এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।“
কতদিনের মধ্যে অনুসন্ধানী কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা প্রস্তাবগুলো হাতে পেলে তারপর সময় সম্পর্কে বলতে পারব। তবে প্রস্তুতি হিসাবে আমরা আগে থেকেই দুটি কমিটি করে রেখেছি। প্রস্তাবগুলো হাতে পেলে তাদেরকে সময় বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি আমরা চিন্তা করব।
“এবার বেশি বিলম্ব হবে না। আমরা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।”
দিনে দিনে শিল্পোদ্যোগ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে। দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা এলএনজির মিশ্রণে বর্তমানে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত করা যাচ্ছে। যদি গ্যাসের চাহিদা ৩৬০০ থেকে ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
চাহিদা ও যোগানের বিশাল এই দূরত্ব ঘোচাতে সরকার এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে আরও বেশি গ্যাস আমদানির চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে নিজস্ব গ্যাস আহরণ করা গেলে ব্যয়বহুল এই আমদানি নীতি থেকে সরে আসা সম্ভব হবে।
অধরা সম্ভাবনা
২০০৮ সালের গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি কনোকো ফিলিপস। কোম্পানিটি দুই বছর অনুসন্ধান করার পর চুক্তি সংশোধন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি জানায়। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় ব্লক দুটি ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ২০১৪ সালে।
অন্যদিকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক দরপত্রে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ফিলিপস ও স্টেট অয়েল। পরবর্তী সময়ে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
একই সময়ে অগভীর সমুদ্র্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দর প্রক্রিয়া এসএস ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস ৪ ও এসএস ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নিয়েছিল। সান্তোস এসএস-১১ ব্লকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করার পর কূপ খনন না করেই বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।
ওএনজিসি দুই ব্লকে থ্রি-ডি ও টু-ডি সাইসমিক জরিপ চালানোর পর ৪ নম্বর ব্লকে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছিল; কিন্তু গ্যাস মেলেনি। এই কোম্পানি আরও দুটি কূপ খনন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার পসকো দাইয়ু করপোরেশন গ্যাসের অস্তিত্ব পেয়েও ২০১৬ সালে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তা চুক্তির বাইরে হওয়ায় সরকার সম্মতি না দেওয়ায় তারা চলে যায়।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অনশোরে ২২টি ব্লকের মধ্যে চারটিতে গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লোর সঙ্গে পিএসসি রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী শেভরন ব্লক ১২, ১৩ ও ১৪ এলাকায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে এবং তাল্লো পেয়েছে ৯ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব।
২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়। পুরো বাংলাদেশকে মোট ৪৮টি অনুসন্ধান ব্লকে ভাগ করার পর স্থলভাগ বা অনশোরে ২২টি এবং জলভাগ বা অফশোরে ২৬টি ব্লক নির্ধারণ করা হয়।
সমুদ্রে ২৬টি ব্লকের মধ্যে স্থলভাগ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে এবং পানির গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০ মিটারের মধ্যে থাকা ১১টি হল অগভীর ব্লক।
অপরদিকে স্থলভাগ থেকে ১৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এবং গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০০ মিটার পর্যন্ত এলাকার ১৫টিকে গভীর ব্লক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগে যেসব অফশোর বিডিং করা হয়েছিল সেখান থেকে কোনো সাফল্য না আসার প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালে সমুদ্র বিজয়ের পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনো বিডিং রাউন্ড আয়োজন করতে পারেনি সরকার।
২০১৯ সালে একটি মডেল পিএসপি তৈরি করা হলেও তাতে ঠিকাদেরদের আগ্রহ নেই বিবেচনায় তা বাতিল করা হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০২৩ সালের জুনে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও অংশীদারত্ব নিয়ে চুক্তির খসড়া নীতিমালা (মডেল পিএসসি) অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
ওই বছর দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে ব্যাপক গুঞ্জন চললেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। চলতি বছরের ১০ মার্চ মডেল পিএসসি-২০২৩ এর আলোকে দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা।
এরইমধ্যে দরপত্র উন্মুক্ত করতে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন।
এছাড়া রয়েছে ১১ সদস্যের মূল্যায়ন কমিটি। এতে অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও একজন আইন বিশেষজ্ঞ।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, “টেন্ডার জমা পড়ার পর পরিস্থিতি দেখে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করব। তার আগে খুব বেশি মন্তব্য না করাই ভালো।”
নতুন পিএসসিতে কী আছে?
বাংলাদেশের পিএসসির জন্য পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেনজি ভারত, মিয়ানমার, বুলগেরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিয়েরালিওন ও পাপুয়া নিউগিনি এর মডেল পিএসসি’র সঙ্গে ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯’ এর বিদ্যমান আর্থিক শর্তাবলীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে।
পেট্রোবাংলার প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্টাক্ট বিভাগের সাবেক একজন পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, নতুন পিএসসিতে ‘প্রাইস মেকানিজম ও প্রাইস ফ্যাক্টর’ পরিবর্তন করা হয়েছে। কস্ট রিকভারিতে আর্লি প্রভিশন রাখা হয়েছে। গ্যাসের প্রাইস করা হয়েছে ব্রেন্ট ইনডেক্সিংয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে। উৎপাদনে আইওসির (ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি) জন্য অংশীদারিত্ব মোটের ওপর ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কস্ট রিকভারি যাতে তাড়াতাড়ি হয় সেই ব্যাপারটা এডজাস্ট করা হয়েছে।
“নতুন পিএসসিতে আমাদের স্বার্থ যেমন এখানে সংরক্ষিত হবে, তেমন তারাও লাভবান হবে। বলতে পারেন একটা উইন উইন সিচুয়েশন হবে।”
বিশ্ব বাজারে এলএনজি দামের চেয়ে যেন বেশি দামে অবিষ্কৃত গ্যাস কিনতে না হয় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে মডেল পিএসসিতে। গভীর সমুদ্রের কূপের ক্ষেত্রে ফার্স্ট রিকভারির পর বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ অংশীদারত্ব পাবে।
অনুসন্ধানকারী কোম্পানির অংশের গ্যাস আগে স্থানীয় বাজারে অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশ নিতে অপারগ হলে ঠিকাদার বাইরে বিক্রি করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। বাইরে গ্যাস বিক্রি লাভজনক হলেও হয় বাংলাদেশ কিনতে পারলে সূত্র অনুযায়ী এদিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
পিএসসিতে অনুসন্ধানকারী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার দর অপরিশোধিত তেলের বাজারদরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে; তা ব্রেন্ড ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দরের ১০ শতাংশ হবে।
আগের যত পিএসসি-বিডিং রাউন্ড
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পিএসসি ১৯৭৪ এর আওতায় অগভীর সমুদ্র এলাকার ৬টি ব্লকের জন্য ৬টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে ৬টি পিএসসি সই হয়। বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য তেল-গ্যাসের মজুদ সম্পর্কে তথ্য না থাকায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো ব্লকগুলো ছেড়ে দেয়।
- পিএসসি ১৯৮৮ এর আওতায় বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করা হলেও কোনো আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি এতে অংশ নেয়নি।
- পিএসসি ১৯৯৩ এর আওতায় অক্সিডেন্টাল, পরে ইউনিকল এবং পরবর্তীতে শেভরনের সঙ্গে ৩টি ব্লক (ব্লক ১২ এবং ১৩ ও ১৪) এর জন্য ২টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। এগুলো বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে।
- পিএসসি ১৯৯৪ এর আওতায় কেয়ার্ন এনার্জি পরে কেয়ার্ন এনার্জি ও শেল এর যৌথ উদ্যোগ এবং পরে সান্টোসের সঙ্গে দুটি ব্লকের (ব্লক ১৫ ও ১৬) জন্য দুটি পিএসসি হয়। ব্লক ১৫ তে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। ব্লক ১৬ তে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদিত হয়। গ্যাস ক্ষেত্রটির মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে স্যান্তোস চুক্তির অবসান ঘটায়।
- মডেল পিএসসি ১৯৯৭ অনুযায়ী ঘোষিত বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে অনশোরের চারটি ব্লকের জন্য চারটি পিএসসি সই হয়। বর্তমানে একটি পিএসসি (ব্লক-৯; তাল্লো) বিদ্যমান রয়েছে।
- মডেল পিএসসি ২০০৮ অনুসরণে ঘোষিত বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ব্লক ডিএস-১০ ও ডিএস ১১ এর জন্য কনোকোফিলিপস এর সঙ্গে একটি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু আর্থিক শর্তাবলী তাদের বিবেচনায় অনুকূল না হওয়ায় ২০১৫ সালে তারা ব্লক দুটি ছেড়ে দেয়।
- মডেল পিএসসি ২০১২ অনুসরণে ঘোষিত বিডিং রাউন্ডের মাধ্যমে অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-১১ এর জন্য স্যান্তোসের সঙ্গে একটি পিএসসি সই হয়। এশিয়া থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ায় তারা ২০২০ সালে ব্লকটি ছেড়ে দেয়।
- অপরদিকে অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-৪ ও এসএস-৯ এর জন্য ওএনসিজি ভিদেশ এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত দুটি পিএসসি বিদ্যমান রয়েছে।
- পরে ২০১৬ সালে মডেল পিএসসি ২০১২ (বিশেষ বিধান আইনের আওতায়) অনুসরণে ব্লক ডিএস-১২ এর জন্য কোরিয়ার পসকো দায়ু এর সঙ্গে একটি পিএসসি সই হয়। পরে তাদের দাম বাড়ানোর দাবির বিপরীতে আর্থিক শর্তাবলী তাদের বিবেচনায় অনুকূল না হওয়ায় পরে তারা ব্লকটি ছেড়ে দেয়।
- অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯ এর আওতায় ২০২০ সালে বিডিং রাউন্ড আহ্বানের পরিকল্পনা করা হলেও কোভিড পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।