ইআরডির সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ফ্লো অব এক্সটারনাল রিসোর্সেস’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) রেকর্ড সর্বোচ্চ পরিমাণ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করেছে সরকার। এ সময় শুধু মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি, যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬৭ কোটি ১৭ লাখ ডলারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বল্পমেয়াদি ঋণ যুক্ত করে তা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে সরকারকে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৬৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রাজস্ব ও রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ না বাড়াতে পারলে এসব ঋণ সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে সরকার বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে এ ঋণ নেয়া হয়। ঋণচুক্তির মেয়াদ অনুসারে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর বিভিন্ন কিস্তিতে এগুলো সুদসমেত পরিশোধ করতে হয় সরকারকে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। যদিও আগের ৩৬ বছরে এ ধরনের ঋণ পরিশোধ হয়েছিল ১২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৯ সালের পর থেকে বিভিন্ন খাতে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকে। উড়োজাহাজ খাতে ২০০৭-০৮ পর্যন্ত ৩৬ বছরে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল মাত্র ৩৭ কোটি ৪ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এবং চারটি ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮। এ চুক্তির আওতাধীন সর্বশেষ উড়োজাহাজ ‘রাজহংস’ আসার মধ্য দিয়ে চুক্তিতে উল্লিখিত সবগুলো আকাশযানই বুঝে পায় বিমান। এগুলো কিনতে নেয়া ঋণ এরই মধ্যে পরিশোধও শুরু হয়েছে। গত ১৫ বছরে উড়োজাহাজ খাতে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৬ কোটি ৫ লাখ ডলার, যা আগের ৩৬ বছরের তুলনায় তিন গুণের বেশি। বর্তমানে বিমানের বহরে আরো ১০টি উড়োজাহাজ যুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
দেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ সামনে আরো বাড়বে উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স, রফতানি ও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ না বাড়ানো গেলে এসব ঋণ বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। গত ১০ বছরের তুলনায় আরো দ্রুত আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। সেবা ও প্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে।’
স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে আলাদা করে কোনো ঋণ পরিশোধ করতে হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালে পর এ খাতে বিদেশী ঋণ গ্রহণ বাড়তে থাকে। এ ঋণ পরিশোধ শুরু হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। এরপর গত ১০ বছরে সরকারকে এ খাতে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬৭ কোটি ৫২ লাখ ডলার। রূপপুর, মাতারবাড়ী, পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মতো বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলে এর পরিমাণ আরো ব্যাপক মাত্রায় বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত দুই-তিন বছরে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে ব্যাপক মাত্রায় ঋণ নেয়া হয়েছে। ফলে মোট ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এসব বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
২০০৯ সালের আগে টেলিযোগাযোগ খাতেও আগে কোনো ঋণ ছিল না সরকারের। গত দেড় দশকে বিদেশী ঋণে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। এ খাতে গত ১০ বছরে পরিশোধ করতে হয়েছে ১ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। এর মধ্যে ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে চীন ও জাপানের ঋণদাতারা। এমন আরো কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। এসব ঋণের বিপরীতে গত দুই বছরে সরকারকে ৬৩ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের জন্য বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসির কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর বাইরেও নানা প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ অর্থায়ন সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। গত ছয় বছরে বিটিআরসির ঋণ বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে ৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার।
আইএমএফের ঋণ পরিশোধ বাবদ গত ১৫ বছরে সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে ১৪৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর আগের ৩৬ বছরে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৩০২ কোটি ৫১ লাখ ডলার। আর সংস্থাটির কাছ থেকে নতুন করে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিচ্ছে সরকার। এসব ঋণ পরিশোধের দায়ও সামনে যুক্ত হবে।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পুরনো ঋণের কিস্তির কারণেও ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগামী দুই বছরে মোট বার্ষিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৫৫০ কোটি বা সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে। ফলে রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে সুদ পরিশোধে সমস্যা তৈরি হবে। আর নতুন বৈদেশিক অর্থায়ন জোগাড় করতে না পারলে আসল পরিশোধে ঝামেলা হবে। তাই রেমিট্যান্স না বাড়লে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হবে। এমনকি প্রয়োজনীয় ব্যয়েও কাটছাঁট করতে হতে পারে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামনে ঋণ পরিশোধ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারে যেতে পারে। তবে সরকারও এখন সতর্ক রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রকল্প নেয়া হচ্ছে না। সামনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি স্বল্প সুদের ঋণ নিতে হবে। আর মেগা প্রকল্পগুলো এখন আর্থিক রিটার্ন দেয়া শুরু করেছে। পদ্মা সেতু থেকে টাকা আসছে। কর্ণফুলী টানেলের মাধ্যমে যাতায়াত সহজ হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে এসব প্রকল্প ভূমিকা পালন করবে। আমরা দৃষ্টিনন্দন কোনো পার্ক গড়ে তুলিনি। ঋণের টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করেছি।’
bonik barta