Site icon The Bangladesh Chronicle

সম্মান ছিল মুখোশ, ভেতরে ভয়ংকর মোজাম্মেল

সম্মান ছিল মুখোশ, ভেতরে ভয়ংকর মোজাম্মেল

ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে আড্ডা জমলে মন্ত্রী বড়াই করে বলতেন, টানা ক্ষমতায় থেকে মোগল সম্রাট আকবরের রেকর্ড ছোঁবেন! তা আর হলো কই। গণঅভ্যুত্থানে হারিয়েছেন গদি। প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কখনোই দেখেননি কারাগারের চার দেয়াল। এখনও এড়াতে চান বন্দিজীবন। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন লুকিয়ে। স্থানীয় নেতাকর্মীর মধ্যে চাউর আছে, তিনি এখনও গাজীপুরেই।

কাউকেই ঘুণাক্ষরে বিশ্বাস করতেন না! তাই হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভার এক নম্বর সদস্য হয়েও এলাকার ঝুট ব্যবসার অবৈধ কামাইয়ের টাকা নিজ হাতে ভাগ করে অন্য রকম মজা পেতেন। প্রকাশ্যে তাঁর ছিল নৌকাবিরোধী অবস্থান। ইউপি চেয়ারম্যান থেকে এমপি– কখনোই ছিলেন না দলীয় পদ ছাড়া। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার পর মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেন। এর পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীর কাছে তিনি ‘ভিন্ন এক মোজাম্মেল’।

কালিয়াকৈর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জানিয়েছেন, আর মাত্র তিন মাস পার হলেই ৫০ বছর ক্ষমতার চেয়ারে থাকার জমকালো আয়োজনের কথা ছিল। সে অনুযায়ী মোজাম্মেলের সমর্থকরা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের ছকও কষছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই ‘শখ’ পূরণ করতে পারেননি তিনি।
১৯৭৩ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ১৫ বছর, এরপর পৌরসভা ও এমপি পদে ধারাবাহিকভাবে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থিতু ছিলেন। তবে মন্ত্রীর বাল্যবন্ধু কাজী মোজাম্মেল হকের দাবি, স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। গাজীপুর সদর আসনের বাসিন্দা হলেও তিনি এমপি হয়েছিলেন কালিয়াকৈর থেকে।

ঝুট ব্যবসায় নজর
জোঁকের মতো ঝুট ব্যবসা কামড়ে ধরেছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল। এলাকার কোন কারখানা থেকে কত টাকা আসবে, সেটি নিজেই নির্ধারণ করে দিতেন।
কালিয়াকৈর পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল ওহাব মিয়া মোজাম্মেলের ঘনিষ্ঠজন। ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওহাব উড়াল দিয়েছেন কানাডায়। সমকাল যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মন্ত্রীর নির্দেশে প্রতি মাসে একটি কারখানা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠত। এই টাকার কিছু অংশ দলের তৃণমূল পর্যায়, অর্থাৎ ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও পৌর শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে দেওয়া হতো। এই টাকা পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্কের ছিল। টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে দিতের মন্ত্রী নিজেই।

টাকার অঙ্ক নির্ধারণের এমন একটি তালিকা এসেছে সমকালের হাতে। আবদুল ওহাবের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই তালিকায়। কোন কারখানা থেকে কত টাকা আসবে এবং সেটি কে পাবে– স্থানীয় সূত্র থেকে পাওয়া কম্পিউটারে কম্পোজ করা ওই তালিকা মন্ত্রী নিজ হাতে কিছু স্থানে কাটাছেঁড়া করেছেন। ওই তালিকায় অন্তত ৬০ কারখানার নাম ছিল।
২০২২ সাল থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে মন্ত্রীর হাতে কখনও ১০ লাখ, কখনও ১৫ লাখ করে টাকা তুলে দিয়েছেন– এমন এক ব্যবসায়ী যিনি এলাকায় ‘ঝুট আলামিন’ নামে পরিচিত। সমকালকে তিনি বলেন, ‘এই টাকা আমি নিজেই মন্ত্রীর কাছে জমা দিতাম, এমনকি মন্ত্রীর সরকারি অফিসে গিয়েও একাধিকবার টাকা দিয়ে এসেছি। মোজাম্মেল হক নিয়মিত মাসোহারা তুলতেন এমন কারখানার সংখ্যা শুধু কালিয়াকৈরেই শতাধিক।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো জানিয়েছে, মন্ত্রীর হয়ে কালিয়াকৈরে এসব কারখানায় ঝুট ব্যবসার পাশাপাশি শ্রমিকের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারীর তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন– আওয়ামী লীগের কালিয়াকৈর উপজেলা শাখার সভাপতি মুরাদ কবীর, সহসাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম তুষার, পৌর শাখার সভাপতি সরকার মোশারফ হোসেন জয়, সাধারণ সম্পাদক সিকদার জহিরুল ইসলাম জয়, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিকদার মোশারফ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আকবর আলী, কালিয়াকৈর উপজেলা শাখার সদস্য মো. ফারুক শিকদার, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ, মৌচাক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা শাখার সদস্য হাজি লোকমান হোসেন। গাজীপুর-১ আসনের বিভিন্ন এলাকায় এসব নেতার বাইরে কোনো কাজ হতো না– এমন জনশ্রুতি থাকলেও ৫ আগস্টের পর এরা সবাই চলে গেছেন আত্মগোপনে। গত দুই সপ্তাহ তাদের মোবাইলে ফোন দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সবার নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।

‘নৌকার মাঝি’ চেনেন না নৌকা
২০১৮ সালে কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দিতে ব্যর্থ হন মোজাম্মেল হক। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই তিনি প্রকাশ্যে ‘আনারস’ প্রতীকের পক্ষে অবস্থান নেন। এ নিয়ে দলীয় বিরোধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, ওই সময়ে উপজেলার ভোটে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাসেল। অন্যদিকে, মন্ত্রীর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন কামাল উদ্দিন সিকদার। ওই নির্বাচনে তাঁর প্রতীক ছিল ‘আনারস’। মন্ত্রী নৌকার প্রার্থী রাসেলকে ঠেকাতে আনারসের পক্ষে মাঠে নামেন। নির্বাচনে হেরে যান নৌকার প্রার্থী। পরে গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন রেজাউল করিম রাসেল। যদিও তিনি মাত্র সাত হাজারের কম ভোটের ব্যবধানে তাঁর কাছে হেরে যান।
এর আগে কালিয়াকৈর পৌর নির্বাচনেও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বর্তমান মেয়র মজিবুর রহমানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ছিল মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে।

মোজাম্মেলের ঘুঘুর ফাঁদ
দল ক্ষমতায় এবং এলাকার এমপি মোজাম্মেল হক মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য হয়েও পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা পাননি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। মোজাম্মেলের ইচ্ছার বাইরে কালিয়াকৈরে কেউ পেতেন না দলীয় পদ। তাঁর ইশারা ছাড়া করা যেত না ব্যবসা-বাণিজ্য।
স্থানীয় নেতাকর্মীর অভিযোগ, বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ (ডিবি হারুন) গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) থাকাকালে এই আসনের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী অহেতুক হয়রানির শিকার হয়েছেন। মন্ত্রীর সামনে অহরহ এমন ঘটনা ঘটলেও মন্ত্রী থাকতেন নীরব দর্শক। মন্ত্রীর রোষানলে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়া আওয়ামী লীগের পদধারী নেতার সংখ্যাও কম নয়।

মোজাম্মেলের ঘুঘুর ফাঁদ দেখা তেমনই একজন আলেয়া বেগম।  কালিয়াকৈর পৌর মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন তিনি। আলেয়ার অভিযোগ, মন্ত্রী তাঁকে অগঠনতান্ত্রিকভাবে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করেছিলেন। ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট দলীয় কর্মসূচি শেষ করে বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এসপি হারুনের ইশারায় সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। যদিও ওই সময় তাঁর নামে কোনো মামলা ছিল না। তিন দিন তিন রাত তাঁকে এসপি অফিসে বসিয়ে রাখা হয়। ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর স্বজনের সঙ্গে আর্থিক দেনদরবার চলায় সে সময় লকআপেও তাঁকে ঢোকানো হয়নি।
আলেয়া বেগম বলেন, প্রথম দিন রাতে গাজীপুর-৩ আসনের এমপি ইকবাল হোসেন সবুজ ও তৎকালীন উপজেলা সভাপতি কামালউদ্দিন সিকদার আমাকে নিতে এসপি অফিসে যান। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসপি হারুন এখন অফিসে নেই। তিনি না আসা পর্যন্ত ছাড়া যাবে না। এর পরদিনই আমার নামে ৬টি চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়। এতে সব মামলায় ১০ কোটি টাকার মতো চাঁদা নিয়েছি– এমন অভিযোগ আনা হয়। এমনকি আমার কাছ থেকে ২ কোটি টাকা উদ্ধারও দেখিয়েছে পুলিশ।

আলেয়া জানান, এসপি হারুন তাঁকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার জন্য বলেন। আামি প্রথমে টাকা দিতে রাজি হইনি। ২ মাস ৮ দিন জেল খেটে সবকটি মামলা থেকে মুক্তির দিনই জেলগেট থেকে ফের এসপি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, আপনার নামে আরও মামলা হচ্ছে। এর পর পরিবারের সদস্যদের চাপে প্রথম দফায় ১০ লাখ এবং পরে আরও ২৮ লাখ টাকা এসপিকে দিয়ে ছাড়া পাই।

এ ছাড়া আলেয়ার একটি বসতঘর দখলে নেন এসপি হারুন। এখনও ওই বাড়ি নিজের আয়ত্তে নিতে পারেননি তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক সদস্য সমকালকে বলেন, মন্ত্রীর রহস্যজনক নীরবতার পেছনে একটা গোপন কারণ ছিল। এসপি হারুন এক দিন মন্ত্রীর একমাত্র ছেলেকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আটক করেন। বর্তমানে তিনি তুরস্কে বাবার জাহাজ ব্যবসা দেখাশোনা করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ওই সদস্য বলেন, ছেলেকে আটক করে এসপি হারুন মন্ত্রীর কাছে খবর পাঠান, কিছুক্ষণের মধ্যে মিডিয়াকর্মী ডেকে তাঁর ছেলের জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে– এমন সংবাদ প্রকাশ করা হবে। এতে মন্ত্রী বিচলিত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসেন। এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে এসপি হারুনের সমঝোতা হয়– গাজীপুরে এসপি হারুনের কোনো কাজে মন্ত্রী হস্তক্ষেপ করবেন না। যে কারণে মন্ত্রী এসব ঘটনা জেনেও নীরব থাকতেন।

মোজাম্মেল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন প্রবীণ নেতা আবদুল মান্নান শরীফ। তিনি ছিলেন কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। ২০০৮ সালে মোজাম্মেল হক প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে খাল খননের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। আবদুল মান্নান শরীফ জানান, ওই দুই প্রকল্পের এক টাকার কাজও করেননি মোজাম্মেল। উপজেলা চত্বরে এক দিন তাঁর কাছে প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি কেন– জানতে চাইলে তিনি ক্ষেপে যান। এর কয়েক দিন পরই উপজেলা আওয়ামী লীগের পদ থেকে সরে যেতে বলেন। এক পর্যায়ে এসপি হারুন ফোন করে তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেন। কেন পদত্যাগ করব– জানতে চাইলে এসপি হারুন খারাপ আচরণ করেন। এক পর্যায়ে দেন প্রাণনাশের হুমকি। পরে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয় তাঁকে। এর পর আওয়ামী লীগের সদস্যপদেও তাঁকে আর রাখা হয়নি।

আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে সমকাল। তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মেয়ে মাহাজাবিন রত্না সমকালকে বলেন, ‘আমার ভাইকে কখনোই পুলিশ আটক করেনি। দেশের বাইরে আমাদের ব্যবসা বা সম্পদ নেই। আমার ভাই দেশেই থাকেন। বাবার সম্মানহানি হোক তা চাই না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই।’

samakal

Exit mobile version