এ ক্ষেত্রে আপাতত কোথাও দলকে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিরোধী দলটির। অবশ্য ভারতের প্রতিক্রিয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে আগামীতে দলের চূড়ান্ত কৌশল গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। দলের একাধিক নীতিনির্ধারক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ কৌশলটি জানা গেছে।
দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতা সমকালকে জানান, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভারত বড় প্রতিবন্ধকতা। প্রতিবেশী ওই দেশকে নিরপেক্ষ করতে এতদিন তারা অনেক ইস্যুতে নীরব থাকলেও এখন থেকে তারা সরব থাকবেন। প্রতিবাদের ভাষাও হবে অনেক ‘তির্যক’। ‘বয়কট’ আন্দোলনেও থাকবে জোরালো সমর্থন। দেশের জনগণের মনোভাবের সঙ্গে সংগতি রেখে ভারতবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করা হবে। তবে কূটনীতির রীতি অনুযায়ী দলকে সেখানে সরাসরি সম্পৃক্ত না করে কৌশলে হাঁটার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। প্রতিবেশী দেশ যদি বাংলাদেশের মানুষ ও গণতন্ত্রের পক্ষে একটা সময় পর্যন্ত অবস্থান না নেয়, সে ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তাও রয়েছে দলের হাইকমান্ডের।
এ বিষয়ে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, এটা একটা সামাজিক আন্দোলন। এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন না। আর দলগতভাবে বিএনপি এই আন্দোলন করছে না। এটা সাধারণ মানুষের বিবেকবোধের সামাজিক আন্দোলন, এটা এভাবেই চলা উচিত।
জানা গেছে, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টসহ কিছু মানুষ ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। দেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণ তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এই সামাজিক আন্দোলনের শুরু। যদিও এর আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতিতে কড়া সমালোচনা শুরু করেন বিএনপির নেতারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু করেন দলটির নেতাকর্মীরা। যদিও এই কার্যক্রমে কখনও বিএনপি নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি।
তবে গত ২০ মার্চ দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। এর পর একদল কর্মীকে নিয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাঁর গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দেন। তখন তাঁর সঙ্গে থাকা কর্মীরা সেই চাদর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ান। পরে এই ঘটনার ব্যাখ্যায় রিজভী বলেন, ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তিনি তাঁর ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ফেলে দিয়েছেন। এর পর থেকেই ভারতবিরোধী প্রচারণায় বিএনপির সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
রিজভী আহমেদের ওই প্রতিবাদের পর গত সোমবার মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের ব্যানারেও ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন’ বক্তব্য ব্যানারে লেখা ছিল। এ অবস্থায় গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলেও এই ইস্যুতে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি দলটি। বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামীতে এটি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা-বিশ্লেষণের পর স্পর্শকাতর এ ইস্যুতে দলের অবস্থান ঠিক করার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে ভারত নিয়ে বিএনপির এমন প্রকাশ্য অবস্থান দলের মধ্যে যেমন কোনো আলোচনা হয়নি, তেমনি কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। যার কারণে রিজভীর এমন কার্যক্রমে দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। আর সেটা নিয়েই দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনায় তোলেন কয়েক নেতা।
বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের কেউ বলছেন, দায়িত্বশীল পদে থেকে রিজভীর এ ধরনের কর্মকাণ্ড শোভনীয় হয়নি। কেউ বলছেন, রিজভী ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে কাজটি করেছেন– এমনটা বললেও সেটি ব্যক্তিগত ছিল না। তবে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলের শীর্ষ নেতার ‘সিগন্যাল’ ছাড়া রিজভীর পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আবার দলের সমাবেশের ব্যানারেও ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ লেখাও সম্ভব ছিল না।
ভারত বিরোধিতা নিয়ে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা সমকালকে জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর শুধু বিএনপি নেতাকর্মী নন, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভারতবিরোধী মনোভাব এখন তুঙ্গে। এ অবস্থায় ভারতবিরোধী ‘পণ্য বর্জন ও বয়কট’ আন্দোলনকে আরও দানা পাকানোর কৌশল রয়েছে।
তাদের মতে, পণ্য বর্জনের আন্দোলন একটি বাহ্যিক বিষয়। এটা আন্দোলনের একটা ছোট উপকরণ। এই আন্দোলনে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন তারা আশা করছেন না। তবে এটাকে ব্যবহার করে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবকে তারা আরও চাঙ্গা করতে পারবেন বলে মনে করছেন।
সুদূরপ্রসারী সুফল পেতে এটাকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন দলের হাইকমান্ড। ‘ভারতবিরোধী’ মনোভাব তীব্র করে জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থানকে পোক্ত করতে চাইছেন তারা। এ জন্য দলের নেতাকর্মীরা ভারতের বিভিন্ন নেতিবাচক দিকগুলোকে সামনে এনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা শুরু করেছেন। নিমো ও প্যারোডি তৈরি করছেন। এর মাধ্যমে বয়কট আন্দোলনকে আরও জোরালো করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর থেকে দফায় দফায় দলের প্রতিনিধি দল ওই দেশে সফরে গিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও ভারতবিরোধী কোনো অবস্থান নেওয়া হবে না বলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গিয়ে ‘ভারতের সঙ্গে বিএনপির বৈরী আচরণ ভুল ও বোকামিপূর্ণ ছিল’ বলে স্পষ্ট করা হয়। তখন থেকেই মনে করা হয়েছিল– এর মাধ্যমে দলটি ভারতবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
দলের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও বিএনপি ভারতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে। ভারতের বিষয়ে অনেকদিন ‘নরম সুর’ দেখায় তারা। যাতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, কোনো দলের পক্ষে না গিয়ে দেশের জনগণের পক্ষে থাকবে– সেটাই চেয়েছিল বিএনপি। তবে সে অবস্থানের বিপরীত অবস্থান নেওয়ায় বিএনপি নেতারা তাদের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাইছেন। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বক্তব্য-বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছেন দলটির নেতারা। সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করছে অভিযোগ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন দলটির নেতারা।
দলের কয়েকজন নেতা জানান, এতদিন ভারত অসন্তুষ্ট হবে মনে করে বিএনপি অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। এর মধ্যে ইসলামী দলগুলোকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি চুক্তিসহ আরও বেশ কিছু ইস্যুতে ‘নীরব’ ভূমিকা পালন করেছে। তবে এবার সেখান থেকে সরে এসে বিএনপি তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে রাজনীতি করবে। দেশের প্রয়োজনে সব কথা বলবে। দলের প্রয়োজনে সবার সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করবে। কোনো রাখঢাক না রেখে বাম-ডান ও ইসলামী দলের সঙ্গে জোট করারও প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। আবার ভিন্ন দিকে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেও কোনো কার্পণ্য দেখাবে না।
দলের সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। যেখানে দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ রয়েছে। এই আন্দোলন কোনো বিশেষ দল কিংবা গোষ্ঠীর নয়। দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে এ দেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি দলকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের ভূমিকার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে এই আন্দোলন। এখানে গুটিকয়েক মানুষ, যারা ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট– তারা ব্যতীত সবাই এই আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন স্পষ্টতই বাধাগ্রস্ত করছে ‘বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সরকার’। তারা তাদের পছন্দের বাইরে যেতে পারছে না। সেখানে বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশাকে ভারত গুরুত্ব দেয় না।
মাঠে থাকলেও কৌশলে গণতন্ত্র মঞ্চ
বিএনপির মতো একই পথে হাঁটছেন ‘গণতন্ত্র মঞ্চে’র শীর্ষ নেতারা। শরিক দলের নেতাকর্মীরা ভারতবিরোধী আন্দোলনে সরব থাকলেও শীর্ষ নেতারা রয়েছেন কৌশলী ভূমিকায়। প্রকাশ্যে তারা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত না থাকলেও রয়েছে মৌন সমর্থন। এ আন্দোলন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জোটগত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকায় দেখা যায়নি তাদের।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ভারতীয় পণ্য বর্জন এখন পর্যন্ত একটি সামাজিক আন্দোলন। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার বিরুদ্ধে দেশের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এটা। ভারত শুধু আওয়ামী লীগের ওপর বাজি ধরতে গিয়ে দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এই প্রতীকী প্রতিবাদে দেশের আপামর জনগণ আর সব গণতান্ত্রিক দলের নৈতিক সমর্থন আছে। এই আন্দোলনের ব্যাপকতা বাড়ছে, বিস্তৃতি লাভ করছে। বহির্বিশ্বেও এর প্রভাব পড়ছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে– সাপ ছেড়ে দিয়ে রশি নিয়ে টানাহেঁচড়া করা যাবে না। তাদের মূল লক্ষ্য ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকার।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলনে দেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। বিগত দিনের নির্বাচনে ভোটের অধিকার খর্ব করে ভারতের সহায়তায় আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় থাকছে। আর তারাও সেটা বড় গলায় বলছে। এখান থেকেই এই ক্ষোভের জন্ম। এটা ন্যায্য ক্ষোভ। আর জনগণের ন্যায্য ক্ষোভ যেখানে আছে, সেখানে তারাও আছেন বলে তিনি জানান।
samakal