- ইকতেদার আহমেদ
- ১২ ডিসেম্বর ২০২২
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় এমন সব রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রচারাভিযানকালে দলের কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে জনসভা আয়োজনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। এরূপ জনসভার আয়োজন ও জনসভায় অংশগ্রহণ দেশের সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত যদিও আয়োজন ও অংশগ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে জনশৃঙ্খলা ও জনস্বার্থের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার শর্ত যুক্ত রয়েছে।
জনসভার আয়োজন ও জনসভায় অংশগ্রহণের মতো সুযোগের সমতা নিশ্চিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে দল এবং আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি সবার সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে দায়িত্ব পালন অত্যাবশ্যক। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য সমসুযোগের ব্যবস্থার প্রতি সংবিধানে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজনে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত বিধিবিধান পালন অত্যাবশ্যক হলেও তফসিল ঘোষণা পূর্ববর্তী সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের তদারকি, তত্ত্বাবধান বা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ বারিত। তফসিল ঘোষণা পূর্ববর্তী সভা, সমাবেশ বা শোভাযাত্রার আয়োজনে মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে পুলিশ কমিশনার এবং জেলা শহর বা উপজেলার ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুমোদন গ্রহণ বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট বিধিবিধান না থাকলেও এ ধরনের অনুমোদন গ্রহণ বর্তমানে প্রচলিত প্রথার রূপ পেয়েছে।
অনেক সময় দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলো যানবাহন চলাচলের সড়ক, খেলার মাঠ বা উদ্যানে জনসভার আয়োজন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সড়কে যানবাহন চলাচল যেন বিঘ্নিত না হয় তা দেখার দায়িত্ব মেট্রোপলিটনের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসন এবং জেলার ক্ষেত্রে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন উভয়ের। খেলার মাঠ বা উদ্যানে জনসভা আয়োজনের ক্ষেত্রে যে কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার ওপর মাঠ বা উদ্যানের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ন্যস্ত ওই সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। জনসভার পরিধি বিস্তৃত হলে মাইক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং এ ক্ষেত্রেও পুলিশ কমিশনার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেন সমসুযোগ সংবলিত মাঠে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পূর্ববর্তী নিজ নিজ কর্মসূচি বা দাবি-দাওয়া জনসম্মুখে তুলে ধরতে পারে তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দল এবং জনপ্রশাসন ও জনশৃঙ্খলায় ন্যস্ত ব্যক্তি সবার ওপর বর্তায়।
আমাদের সংবিধানে বর্তমানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ক যে বিধান রয়েছে তাতে একটি সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করলে তার কার্যকাল নির্বাচন পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর হলেও মেয়াদ পূর্ণের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচন-পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠক ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ অনুষ্ঠিত হয়। সে হিসাব অনুযায়ী আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্তমান সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করলে ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর মেয়াদ পূর্ণের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হলে সে ক্ষেত্রে ভেঙে দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে সে বিবেচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করে ইতোমধ্যে তিনটি জেলায় প্রচারণামূলক জনসমাবেশ সম্পন্ন করেছে। অপর দিকে, দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১০টি বিভাগীয় শহরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের আয়োজনের প্রচারাভিযানে জনসমাবেশ সম্পন্ন করেছে। উভয় দলের জনসভাবিষয়ক খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো অবলোকনে দেখা যায়- ক্ষমতাসীন দল নির্বিঘ্নে জনপ্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তাদের জনসভার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারলেও বিরোধী দল বিএনপিকে প্রতিটি জনসভা আয়োজনে বিরূপ প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের জনসভায় জনসমাগম সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত করার জন্য স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা বন্ধ রেখে জনসভা স্থলে আগমনের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থাসহ নগদ অর্থ, খাদ্য ও দ্রব্যসামগ্রী বিতরণের তথ্য পাওয়া যায়। এর বিপরীতে বিএনপি আয়োজিত জনসভাগুলোর ক্ষেত্রে জনসভা অনুষ্ঠানের দু-তিন দিন আগে থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় এবং জনসভার সংবাদ প্রচারে বিঘ্নের নিমিত্ত ইন্টারনেট সেবা সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়। এতদসত্ত্বেও দেখা যায়, সব ধরনের বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বিএনপির প্রতিটি জনসভার সমাবেশস্থলে উপচেপড়া জনসমাগম ঘটেছে। কিছু কিছু জনসভাস্থলে আনুষ্ঠানিক জনসভা শুরুর এক বা দু’দিন আগে থেকেই জনসমাগম হতে দেখা যায়। বিএনপির ১০টি জনসভার মধ্যে রাজধানী শহর ঢাকার জনসমাবেশটি ছিল শেষ জনসমাবেশ। বিএনপি এটি তাদের ঢাকার পুরানা পল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সম্মুখে অনুষ্ঠানের আবেদন করলেও মেট্রোপলিন পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠানের অনুমোদন দেয়। নানা নাটকীয়তার পর সমাবেশটি গোলাপবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশটিতে জনসাধারণের আগমন ঠেকাতে ঢাকামুখী সব গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হলেও জনসভা স্থল ও এর আশপাশের এলাকা জনমানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গত ৭ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুহুর্মুহু টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে উপস্থিত জনসমাগমকে ছত্রভঙ্গ করে দলীয় কার্যালয়ে জোরপূর্বক প্রবেশ, ভাঙচুর, সিসিটিভি ক্যামেরা বিনষ্ট ও বোমা স্থাপনের হীন কার্যক্রম সাংবাদিকদের মোবাইলে তাৎক্ষণিক ধারণকৃত চিত্রে প্রত্যক্ষ করা গেছে যা সত্যিই দেশ ও জাতির জন্য হৃদয়বিদারক এবং মর্মবেদনার কারণ।
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়- জনসাধারণ ও যান চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য তাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। বিএনপি সূত্রে প্রকাশ, দলটি প্রায়ই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে ও প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। ইতঃপূর্বে এরূপ আয়োজনের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়নি। প্রণিধানযোগ্য যে, শাহবাগ চত্বরে ২০১৩ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট সংগঠন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ দীর্ঘ কয়েক মাসব্যাপী সড়ক অবরোধ রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও পুলিশের বিবেচনায় তাতে জনমানুষের ও যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটেনি। ধানমন্ডির ৩২ নং সড়কের প্রবেশমুখ দিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ যান চলাচল বন্ধ থাকলেও তার কোনো ব্যাখ্যা বা সদোত্তর নেই। অনুরূপ এরশাদ রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন বঙ্গভবনের সম্মুখস্থ ১০০ ফুট প্রশস্ত সড়কের দক্ষিণ মাথায় স্থায়ীভাবে প্রাচীর নির্মাণ করে যান চলাচল রুদ্ধ করে বিকল্প হিসেবে গুলিস্তান পার্কের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তার মাধ্যমে হাটখোলা অভিমুখে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয় যা অদ্যাবধি চলমান। পৃথিবীর অপর কোনো দেশে সাধারণ জনমানুষের চলাচল রোধ করে বিশেষ ব্যক্তিদের যাতায়াতে এ ধরনের ব্যবস্থা কি বিদ্যমান রয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত। এ কার্যালয়টির সম্মুখে প্রায়ই দলটির এবং এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সভা-সমাবেশ চলাকালীন সড়কটির মধ্য দিয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে জনশৃঙ্খলা ব্যাহত হয় কি না সে প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্টদের কাছ থেতে কখনো কি পাওয়া গেছে? তাছাড়া যান চলাচল বিঘ্নের অজুহাতে পুলিশ কর্তৃক ৭ ডিসেম্বর বিকেল থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় হয়ে বিএনপির নয়াপল্টনস্থ কার্যালয় অভিমুখী সড়কে জন ও যান চলাচল পরবর্তী তিন দিবস বন্ধ রাখলেও তাতে জনজীবনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল কি না এর উত্তর কে দেবে?
সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন যেকোনো স্বীকৃত সংগঠনের সাংবিধানিক অধিকার। এরূপ সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় দলীয় সমর্থকসহ দলীয় শুভানুধায়ী ও সাধারণ জনমানুষের অংশগ্রহণ সংবিধান ও আইনে সমর্থিত। সংবিধান ও আইন দেশের সব নাগরিকের জন্য সমসুযোগের নিশ্চিয়তা বিধান করে। সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে ক্ষমতাসীন দল বা ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ দল ও সংগঠন বিশেষে যদি অসম আচরণ করে সে ক্ষেত্রে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের চেতনা পরাভূত হয় যা প্রকারান্তরে সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com