Site icon The Bangladesh Chronicle

সব ফলেই বিষ, মুনাফাই যেন শেষ কথা

– ছবি : নয়া দিগন্ত


ফল খাওয়ার উপকারিতাগুলো যেকোনো বয়সের যে কারো জন্যই দারুণ। একদম ছোট শিশু থেকে শুরু করে, কিশোর-তরুণ, প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও নিয়মিতভাবে ফল খাওয়া উচিত এবং প্রতিদিন কিছু পরিমাণে হলেও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। ডাক্তারি বিদ্যায় বলা হয়, ফল শুধু স্বাদের জিনিস নয়। ফল খাওয়া দরকার শরীরে মিনারেল আর ভিটামিনের চাহিদা জোগান দিতে। সেটি বেশি দেশী ফলে। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং বি কমপ্লেক্স রয়েছে বাংলাদেশের মৌসুমি ফলে। বলা হয়ে থাকে, বিদেশী ফলে ফরমালিন বা কেমিক্যাল মেশানো থাকে। এর উল্টো অর্থ হচ্ছে, দেশী ফল কেমিক্যালমুক্ত। এই ভরসায় দেশী ফলের প্রতি আকর্ষণ এবং দুর্বলতা অনেকের। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও নানা দুঃসংবাদ। দেশী ফলেও ফরমালিন মেশানোর ঘটনা ধরা পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।

দেশী ফলের মধ্যে প্রায় সব ফলেই ফরমালিন মেশানো হয়। ইথোফেন নামের বিষাক্ত হরমোনাল স্প্রে দিয়ে কাঁচা ফল পাকানো হয়। আবার পচা ফল তাজা রাখতেও কেমিক্যাল রয়েছে। সাধারণত কৃষিজমিতে ব্যবহার হলেও রমজানকে সামনে রেখে কাঁচা ফল পাকাতে এই স্প্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ফরমালিনের চেয়েও ভয়ানক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তরমুজের ভেতর সিরিঞ্জ দিয়ে ক্ষতিকর এরিথ্রোসিন বি এবং স্যাকারিন পুশ করে লাল ও মিষ্টি করার কাণ্ডও ধরা পড়েছে। বাদ পড়ছে না আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারসও। জাতীয় ফল কাঁঠালও এর বাইরে নয়। এক সময় ‘ঘাই’ দিয়ে কাঁঠাল পাকানোর কথা শোনা যেত। ‘ঘাই’ মানে পেরেক ধরনের একটি রড বা পাইপ দিয়ে বোঁটার দিক ফুটো করে দেয়া। এতে কাঁঠাল দ্রুত পাকে। এখন ঘাইয়ের সাথে বিষও দেয়া হয়। এ তালিকার সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ফলের নাম কলা। বাংলাদেশে সবরি-চাঁপা-সাগর কলা উৎপাদন করা হয়। সময়ের আগে কলায় বিশেষ করে সবরি কলায় হরমোন ¯স্প্রে করা হচ্ছে। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভের হিট দিয়ে নরম করা হয়। রাইপেন-ইথোফেন বা কার্বাইড স্প্রে করে পাকানো হয়। স্প্রে করার আগে কলা পরিষ্কার করা হয় সার্ফএক্সেল বা শ্যাম্পু দিয়ে। পাকানোর এই বিষাক্ত পদ্ধতি রাজধানীর বাদামতলী থেকে কাওরানবাজার এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলার আড়তে চলছে হরদম। সেই বিষাক্ত কলা বাজার থেকে কিনে খায় মানুষ। মৌসুমি আরেক দেশী ফল লিচুতেও পাঁচ থেকে ছয়বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। ঝরে না পড়া, বোঁটা শক্ত রাখা, রঙ চকচকে করাসহ সব কিছুর জন্য বিষ দেয়া হয়। এখন আবার আমড়া-জাম্বুরা পর্যন্তও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে।

এ ছাড়া অপরিপক্ব কোনো কোনো ফল পাকাতে ইথোফেনের বাইরে ক্যালসিয়াম কার্বাইডও মেশানো হচ্ছে। রঙ উজ্জ্বল করতে এটি মূলত টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহার হয়। গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করায় ফলগুলো ঔজ্জ্বল্যের সাথে রীতিমতো বিষে পরিণত হয়।

এসব ফল খাওয়ায় মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল। এর জেরে শরীরে বাসা বাঁধে নানা অসুখ-বিসুখ।

একেবারে সাধারণ চাষি থেকে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী সবাই যার যার জায়গায় ফলে বিষ মেশানোর অনৈতিকতার মাধ্যমে মানুষকে রোগী বানানোর কাজটি করছেন। লিচু বা আম বাগানগুলো মুকুল আসার আগে-পরে বড় ব্যবসায়ী, সুপার শপগুলো কিনে নেয়। বিষ মেশানোর অপকর্ম তারাও করে। কারো বিবেক স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। মুনাফাই যেন তাদের কাছে শেষ কথা, মানুষের জীবন নয়।

আমদানি করা ফলে ফরমালিন পরীক্ষা করতে ঢাকার বিএসটিআইয়ের অফিসে পাঠালে সময় লেগে যায় মাসখানেক। তদ্দিনে ওই সব ফল পচে যায়। সে ক্ষেত্রে বন্দরে তাৎক্ষণিক ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। দেশী ফলের ক্ষেত্রে সেই জটিলতা নেই মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবটা কঠিন। বাংলাদেশ থেকে কিছু রফতানি করতে হলে কঠোর মান রক্ষা করতে হয়। দেশীয় লেবু- কাগজি, জাম্বুরা, টমেটো জাতীয় ফল রফতানির সময় ‘এনওসি’ নিতে হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে। সেখানকার কর্মকর্তাদের সামনে এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ওই ফলগুলো ধুতে হয়। পরে তারা ফাইটোস্যানিটারি সনদ দেন, যেটা ইউরোপের দেশগুলো গ্রহণ করে।

আমাদের দেশ থেকে ফল ও সবজি রফতানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফলগুলো ধোয়া হয় ফলের গায়ে লেগে থাকা নানা আবরণ ওঠানোর জন্য। একসময় বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের ফল রফতানি হলেই তারা নষ্ট করে ফেলত। পরে তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়। তাদের প্রতিনিধি দল তিন-চারবার বাংলাদেশ সফরের পর ওই রাসায়নিক দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দেয়। তা-ও সাময়িকভাবে। বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশ থেকে ফল রফতানির ক্ষেত্রে রফতানিকারকরা সরাসরি বাগান থেকে ফল কেনেন। তারা কোনো রাসায়নিক ব্যবহারের চিন্তাও করেন না। কারণ ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি হওয়া ফলের ৯৫ শতাংশের ক্রেতা অনাবাসী বাংলাদেশীরা।

বিএসটিআই বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ফলসহ ফরমালিন মেশানো খাদ্যবস্তু শনাক্ত করেছে। কিন্তু মানুষ নিশ্চিন্তে যাতে ফল কিনতে পারে বা কেমিক্যালমুক্ত ফল চেনার কৌশল বাতলে দিতে পারেনি। এ অবস্থায় মানুষকে ফল মুখে দিতে হচ্ছে ‘আল্লাহর হাওলা’ হয়েই। তবে, কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণে উপসর্গগুলো সম্পর্কে নিয়মিত বলছেন আমাদের চিকিৎসকরা। লক্ষণ হিসেবে রয়েছে পেটে ব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথা ঘোরা, মল পাতলা বা হজমবিঘ্নিত মল, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, এ ছাড়া পালস রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্যের কারণে দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতীদের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বছর কয়েক আগে ফল পাকানো ও সংরক্ষণে কেমিক্যালের ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা ছাড়াও ফলমূলে কেমিক্যাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। দূষিত ফল যেন কেউ গুদামজাত ও বিক্রি করতে না পারে তা সর্বদা মনিটর করার জন্য বিএসটিআই ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আদালত দেশের স্থল ও নৌবন্দরে আমদানি করা ফল কেমিক্যাল মেশানো কি না তা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দেন। কিন্তু, সেই নির্দেশ পালনের হালনমুনা তো যে কারোই বোধগম্য।

সমাজের সর্বস্তরে এমন অবক্ষয়-অনৈতিকতার এই মাত্রায় আর কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই। তবে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-নেপাল-ভুটানেও নেই, তা বলতে পারি। মিয়ানমারের অবস্থাও এমন নয়।

থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান, কোনো দেশের মানুষ খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মেশানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না। ইউরোপ-উত্তর আমেরিকায় ফল বা খাবারে ভেজাল বা বিষের কথা কল্পনাও করা যায় না। দক্ষিণ আফ্রিকায় দিনে-দুপুরে ছিনতাইকারীরা মানুষ হত্যা করে মাঝে মধ্যেই। কিন্তু প্রকৃতির ফলে বা খাবারে তারা কখনো বিষ মেশায় না। ল্যাটিন আমেরিকার মেক্সিকো, ব্রাজিলের সমাজেও এমন নেই।

তাই সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের মানুষের পচনটা ধরেছে মাথায়। এর আগে নষ্ট হচ্ছে শরীরের অন্যান্য কল-কব্জা। বেড়েই চলছে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, হার্ট-কিডনি ফেইলিউর, হাঁপানিসহ নানা অসুখ। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য যে ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়, এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তা হলো- অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চরক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি।

সুতরাং পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাই কঠোর আইনের প্রয়োগ। বিদেশ থেকে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি, সংরক্ষণ, মজুদকরণ, বিতরণ, ব্যবহার ও উন্মুক্ত বিক্রির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথেষ্ট অগ্রণী ভ‚মিকা নিতে হবে এবং জনগণকে বিষমুক্ত ভেজাল ফল ক্রয় ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র ও বিভিন্ন গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com

Exit mobile version