- মইনুল হোসেন
- ০৪ জুলাই ২০২০
আমরা যতটা জানতে এবং বুঝতে পারছি তার আলোকে বলতে পারি যে, অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ঝুঁকিমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারব এমন পূর্বাভাস ডাক্তার-বিশেষজ্ঞরাও দিতে পারছেন না। সুতরাং মামলাগুলো যাতে দ্রুত এবং সহজে নিষ্পত্তি করা যায় সে রকম কার্যবিধি সময়ের দাবি মিটিয়ে সমন্বিত করতে হবে। সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করার জন্য বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি উদার হতে হবে। তাদের একটু বেশি দায়িত্বও নিতে হবে। বুঝতে হবে, আইনি তর্ক-বিতর্ক ও অর্থবহ শুনানি ভিন্ন বিচারব্যবস্থাকে শিশুদের ভিডিও গেমস মনে হবে।
লিখিত যুক্তি-তর্কের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে যাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয়। অর্থাৎ সঙ্কটকালীন সময়ে বিচারিক পদ্ধতিতে বিচার সম্পন্ন করার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। স্বাভাবিক নিয়মে বিচারকার্য পরিচালনা করার কথা ভেবে বিচার কাজ অসম্ভব হবে এটা বলার সুযোগ নেই। বিদেশে বিচারকার্যের সুবিধার্থে আইনের পরিবর্তন করা হচ্ছে এবং তা বিচারকরাই করে নিচ্ছেন।
অনলাইনে বিচার পরিচালনার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। অন্যান্য দেশে খোঁজখবর নিলেও জানা যাবে। জজ-বিচারক ও আইনজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
এমনিতেই সরকার আইনের শাসনের বিচারে বিশ^াস করে না। বিচারব্যবস্থা চলবে তাদের নির্দেশে। আইনমন্ত্রীর জন্য এটা বড় ফুটানির বিষয় যে, বিচারব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিচারব্যবস্থা অবরুদ্ধ থাকলে সরকারের জন্য তা খুশির খবর হবে।
আইনজীবীরা তো বলেই যাচ্ছেন যে, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক পরিধান করে বিচারকার্য পরিচালনা সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারের কিছু করার নেই। বিচারব্যবস্থায় আইনজীবী ও বিচারকদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে কোর্ট রুমে বসার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। যাতে আইনজীবী ও বিচারকদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা সুরক্ষিত রেখে জনগণকে সুবিচার প্রদান করা যায়। আমাদের কথা হলো, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ চালু করতে হবে। শুধু জামিন সংক্রান্ত জরুরি বিষয়ের শুনানি করলেই বিচার বিভাগ কাজ করছে বলা যাবে না।
বেশির ভাগ আদালত এবং সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ অকার্যকর অবস্থায় আছে। সুতরাং বিচারকদের একটা বড় অংশ চিন্তাভাবনা করার জন্য প্রচুর সময় পাচ্ছেন। এই সময় কাজে লাগিয়ে মামলা জট থেকে বেরিয়ে আসার একটা পরিকল্পনা প্রণয়নে সম্মিলিত চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। আইনজীবীরা তো সরকারি বেতনভাতা পান না, তাদের আয়-উপার্জনের কথা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।
আদালতগুলো সীমিত পরিসরে অনলাইন বিচারব্যবস্থা চালু করেছে। এর ফলে বিচারক এবং আইনজীবীরা ইতোমধ্যে এই ব্যবস্থার জটিলতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। সুবিচারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পথে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। আমরা জানতে পেরেছি, এই ব্যবস্থায় আইনজীবীরা আস্থা নিয়ে মামলা পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
জরুরি ভিত্তিতে শুধু জামিন সংক্রান্ত কিছু কিছু মামলার শুনানি হচ্ছে। অপরাধের গুরুত্ব দেখে বিচারকরা নিজেরাই জামিন দিতে পারেন। এ জন্য অনলাইনে আইনজীবীর করণীয় খুব কমই থাকে। জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার হিসেবে দেখলেই হয়। ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো অর্থহীন করার জন্য এফআইআরই যথেষ্ট হতে পারে না।
অনেক মামলার শুনানি শুরু হয়েও শেষ হওয়ার পথে আটকা পড়ে আছে।
বিচারকদের সাথে আইনজীবীদের মুখোমুখি শুনানি না হলেও সুবিচার পাওয়া যাবে, এ ব্যাপারে মক্কেলরাও সন্তুষ্ট বা আশ^স্ত হতে পারছেন না। যদি মনে হয়, অনলাইন ছাড়া অন্য কোনোভাবে কোর্ট চালু রাখা যাবে না তাহলে সব কোর্ট-আদালতে বিচার পদ্ধতি চালু করা হোক। আইনজীবীরা আসতে না পারলে নথিপত্র ও লিখিত যুক্তিতর্কের ওপর নির্ভর করে বিচার সমাধান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। একমাত্র জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে ডেকে পাঠানো যাবে।
বিচারকদেরই মূল দায়িত্ব সুবিচার প্রদান করার। জনগণ আইনজীবীদের সাহায্য নিয়ে বিচারকদের কাছ থেকে সুবিচার পেতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুবিচার করেন বিচারকরা। বিচারিক উদ্বেগ এবং দায়দায়িত্বের গুরুভার তাদেরই বেশি বহন করতে হয় এবং তাদেরই দেখতে হবে বিচারিক প্রক্রিয়াকে কতটা উন্মুক্ত এবং সক্রিয় করা সম্ভব। আমি বলছি না যে, করোনাভাইরাস সৃষ্ট বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বিচারপ্রক্রিয়া চালু করার সিদ্ধান্ত সহজ। সময়ও সহজ নয়। তাই এ ব্যাপারে সব বিচারককে ভাবতে হবে, বসে থাকলে চলবে না। এ দায়িত্ব শুধু আইনজীবীদের দাবির বিষয় নয়। জনগণের প্রতি সুবিচার প্রদানের দায়িত্ব পালন ভিন্ন বিচারব্যবস্থা জনগণের কাছে অর্থহীন হয়ে থাকবে।
প্রতিবেশী ভারতের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আমার জানা নেই। কিন্তু সেখানে অনলাইন বিচারব্যবস্থা চালু আছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিশ্চয় বসে নেই। অন্যান্য দেশে কিভাবে সমস্যাটির সমাধান খোঁজা হচ্ছে তা জানার চেষ্টা নিশ্চয়ই করছেন। পাকিস্তানে স্বাভাবিক ব্যবস্থায়ই বিচারকার্য চলছে। করোনাভাইরাসের মহামারীর প্রভাবকে বড় করে দেখা হচ্ছে না। অফিস, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট ও মিল-কারখানা ইত্যাদি যখন চলতে পারছে তখন আমরা কেন বিচার প্রদান প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পালনে অসহায় হয়ে থাকব?
বিচারব্যবস্থা অন্যদের চাকরির দায়িত্ব পালনের মতো নয়। ফাইল নড়াচড়ারও ব্যবস্থা নয়। বিচারকদের অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণের বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে। বিচার কার্যক্রমে বিচারক ও আইনজীবী একে অপরের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। সার্বিকভাবে বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
বিচারকরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নন এ কথা বলে আমরা তাদের ছোট করতে পারি না। জজ-বিচারকদের শক্তি আইনজীবী ও জনগণ। এ কারণে তাদের শক্তি জোগানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কাজটি কঠিন বলেই তাদেরও কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কঠিনভাবে ভাবতে হবে। কোর্টে না গিয়ে বিচার পরিচালনা করার বিষয়টি জনগণ আস্থার সঙ্গে নিচ্ছে এমন মনে হচ্ছে না। বিচার প্রক্রিয়ায় জনমনের আস্থার প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বিচারক ও আইনজীবীদের সুরক্ষা দেয়ার ব্যাপারে বিচারপতিদের উদ্বেগ প্রশংসনীয়। কোর্ট এককভাবে কোনো সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না, এ কথাও সত্য। আইনজীবীদের মক্কেলদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়। আইনজীবীদের কোর্টের আচরণবিধি দায়িত্বের সাথে মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকে। অফিসের সব কাজকর্ম বাসায় বসে করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের কাজ করার জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে বিচারক-আইনজীবীদের জন্য কিছু একটা করা সম্ভব হবে না কেন।
আমরা যে বিষয়টির ওপর জোর দিতে চাচ্ছি তা হলো : নিম্ন আদালত এবং সুপ্রিম কোর্টের সব বেঞ্চের কার্যক্রম সচল রাখতে হবে। বিচার কার্যক্রম থেমে থাকবে না। কোর্টের সব মামলাই জরুরি। মক্কেলরা শেষ ভরসার স্থল হিসেবে কোর্টে আসেন। তাই মহামারীর বিপজ্জনক প্রেক্ষাপটে কোন মামলাগুলো অধিকতর জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ধারণ করার ব্যাপারে আইনজীবীদের অবশ্যই সহযোগিতা দিতে হবে।
নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের বেশির ভাগই অনলাইনে মামলা পরিচালনা করতে অনেক অসুবিধা পোহাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক আইনজীবীর অনলাইন সুযোগ-সুবিধা আছে, তাই তাদের বেশির ভাগই কাজ করতে গিয়ে ভিড় করছেন এবং সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন। অনলাইন কোর্ট মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বসছে। এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে, অনলাইন প্র্যাকটিস আইনজীবী ও জজদের জন্য মোটেই সুবিধাজনক নয়।
জজ এবং আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাথমিক উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু কোনো কাজ না করে ঘরে বন্দী জীবনযাপনও অর্থহীন। ভার্চুয়াল সার্ভার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়ারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের অবশ্যই পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। বর্তমানে যেসব কোর্টে অনলাইনে কাজ করার ব্যবস্থা চালু আছে তা চালু থাকুক। অন্যান্য কোর্ট বন্ধ না রেখে করোনাভাইরাসের ব্যাপারে সুরক্ষা পাওয়ার কার্যকর পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। মূল সমস্যা হলো, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী একটা পন্থা বের করা জরুরি। দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সহযোগিতা পেতে অসুবিধা নেই। মাস্ক ব্যবহার করা কোনো সমস্যা নয়।
এই মুহূর্তে কোন মামলাগুলো জরুরি সেটি তো বিচারক এবং আইনজীবীরা মিলেই নির্ধারণ করতে পারেন। কিছু করা যাবে না এমনটি ভাবার সময় এখন নয়। যেসব মামলার অংশবিশেষের শুনানি হয়েছে সেগুলো শেষ করতে হবে। এই সঙ্কটকালে জজ এবং আইনজীবী উভয়পক্ষকে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সময়ের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হবে, বুঝতে হবে স্বাভাবিক পথ খোলা নেই। আমাদের কর্মব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে জীবনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। কোর্ট থাকবে, বিচার থাকবে না তা তো হতে পারে না।
বিচারিক ব্যবস্থাকে অবরুদ্ধ রাখাটা বিকল্প হতে পারে না। কোর্টে বসার ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের জন্য প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত হবে। সমস্যাটি যেহেতু রোগসংক্রান্ত সুতরাং আমাদের উচিত হবে বিচারব্যবস্থা চালু রাখার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাহায্য গ্রহণ করা। সব জজ-বিচারককেই বিচারকার্য পরিচালনায় সক্রিয় হতে হবে।
সবাইকে জীবনের একটা অত্যন্ত কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। রোগ হিসেবে করোনাভাইরাস তেমন ভয়ঙ্কর রূপ গ্রহণ করতে পারত না যদি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসুবিধা থাকত। মাস্ক ব্যবহার করার পাশাপাশি নিরাপদ দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি খরচে আরাম-আয়েশে থাকার রাজনীতি করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষে সাধারণ মানুষের ব্যাপারে কর্মব্যস্ততা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ দিয়ে যতটুকু সম্ভব ততটুকু করাই যথেষ্ট নয়। সরকারি নির্দেশের অপেক্ষায় থাকলে বিচারব্যবস্থাই থাকবে না। সরকারকে বিচারব্যবস্থা নিয়ে কোনো দুর্ভাবনায় থাকতে হবে না। সরকার আর পুলিশ মিলেই বিনাবিচারে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জনসাধারণের ওপর শাসন চালিয়ে যেতে পারছে। জনগণকে সুবিচার দেয়ার প্রশ্নে চিন্তাভাবনা যা করার তা জজ-বিচারক ও আইনজীবীদেরই করতে হবে।
যেকোনো ব্যবস্থায়ই হোক বিচারব্যবস্থাকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করতে হবে। কোয়ারেন্টিনে গেলে চলবে না।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে একেবারে নিñিদ্র ঝুঁকিমুক্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। যত দিন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃৃত না হচ্ছে তত দিন ঝুঁকিমুক্ত জীবনে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে না। তাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে দূরত্ব বজায় রেখে কোর্ট-আদালত কার্যকর হতে পারে।
লেখক : প্রবীণ আইনজীবী