ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দশম সংসদ থেকে সাবেক মন্ত্রীদের একই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি না করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মনে করেন, সাবেক মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি করার ইতিবাচক দিক রয়েছে। ওই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁর সব বিষয়ে ভালো ধারণা থাকে। তাই অন্য কারও চেয়ে তাঁর পক্ষেই অধিকতর জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সাবেক মন্ত্রীদের সংসদীয় কমিটির সভাপতি হওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘সাধারণত সংসদীয় কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের পূর্ববতী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নানা অনিয়মের অভিযোগ আসে। আগের মন্ত্রীরাই যখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান, তখন কীভাবে কমিটি এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবে!’ তিনি আরও বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য হওয়া গুরুতর বিষয়। এজন্যই দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট ও স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। সাধারণ মানুষের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা হচ্ছে।’ সরকার এটা পুনর্বিবেচনা করবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধন) আইন ২০০৯-এ সংসদ সদস্য প্রার্থীদের পেশা ও আয়ের উৎসসহ কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তিগত বা যৌথ সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দশম সংসদ চলাকালে সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করতে টিআইবি একগুচ্ছ সুপারিশ করে। এর মধ্যে রয়েছে– সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি সংশোধন করে সভাপতি ও সদস্যদের বাণিজ্যিক, আর্থিক সম্পৃক্ততার তথ্য প্রতিবছর হালনাগাদ করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা, কমিটির সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্ব-সম্পর্কিত তথ্য পুরোপুরিভাবে যাচাই করা এবং কোনো সদস্য কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির পর কমিটি-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া গেলে, প্রমাণ সাপেক্ষে ওই সদস্যকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার বিধান করা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যকর চর্চা সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর দ্বাদশ সংসদ হচ্ছে একক দলের একচ্ছত্র ভুবন। এ অবস্থায় সংসদ ও সংসদীয় কমিটির কার্যকারিতা আশা করা অলীক।’ তিনি বলেন, ‘তবুও যেটা হতে পারত, সেটাও হলো না। যদি তা হতো সংশ্লিষ্টদের ব্যবসা যেখানে আছে, সেখানে পরিহার করা যেত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সাবেক মন্ত্রী যদি সেই মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি বা সদস্য হন, তখন তাঁর সময়ের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ আসবে না, আবার এলেও লোক দেখানো আলোচনা হবে। তাই এসব কমিটির কাছে কিছু পাওয়ার আশা করা বাতুলতা।’
চলতি সংসদে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়েছেন নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত এইচ এম ইব্রাহীম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০০৭ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক কারখানার মালিক ছিলাম। এখন ওই ব্যবসায় নেই। তাই এই কমিটির সভাপতি হওয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ এই কমিটির সদস্য শামীম ওসমানের রয়েছে তৈরি পোশাক ব্যবসা (উইসডম নিটিং মিলস)। অপর সদস্য এস এম আল মামুন শিপব্রেকিং ব্যবসায় যুক্ত।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে। তাঁর পোশাকশিল্প ও অন্যান্য ব্যবসা আছে। কমিটির আরেক সদস্য সুলতানা নাদিরা মধুমতি টাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু লঞ্চের মালিক। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সেলিম মাহমুদ আন্তর্জাতিক আইন ও জ্বালানি বিষয়ক পরামর্শক। এই কমিটির সদস্য আবদুর রউফের পেট্রোল পাম্পের ব্যবসা আছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ৩৯টি সংসদীয় কমিটির ১২টিতে সভাপতির পদ পেয়েছেন সাবেক ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি গোলাম দস্তগীর গাজী, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি টিপু মুনশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শ ম রেজাউল করিম, ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর উশৈসিং, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শরীফ আহমেদ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে জাহিদ আহসান রাসেলকে।
এ বিষয়ে সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, ‘সদ্য সাবেক মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তারা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সংসদীয় কমিটিকে গতিশীল করতে পারবেন। ব্যবসা অনেকের আছে, যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। দেখতে হবে তারা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কিনা।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসায়ী হলেই কমিটিতে রাখা যাবে না বা স্বার্থের সংঘাত তৈরি হবে– এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনই ঠিক নয়। কমিটি কাজ শুরুর পরে এ বিষয়ে হয়তো বলা যাবে।’ তবে তাঁর মতে, আগের মন্ত্রীকে সভাপতির পদে রেখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আগের অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা নিয়ে কমিটিতে আলোচনা আশা করা যায় না।
samakal