Site icon The Bangladesh Chronicle

সংঘাত আরো বিস্তৃত হয়েছে মিয়ানমারে, সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সেনাবাহিনী

সোথে এলাকার একটি সড়ক পাহারা দিচ্ছে মিয়ানমারের সৈন্যরা। – ছবি : বিবিসি

মিয়ানমারের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সামরিক বাহিনী বা সরকারের সংঘাতের ইতিহাস পুরনো হলেও এখন সেটা আরো বিস্তৃত হয়ে উঠেছে।

আদিবাসী বা বিচ্ছিন্নতাপন্থী গ্রুপগুলোর সাথে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করেছে গণতন্ত্রপন্থী যোদ্ধারা।

সীমান্ত বা দূরবর্তী অঞ্চলগুলোয় একসময় সংঘাতপ্রবণ হলেও এখন সেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলেও।

পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, মিয়ানমারে এখন যে অবস্থা চলছে, তাতে অচিরেই দেশটি একটি পুরাদস্তুর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

মিয়ানমারের এই সংঘাতের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতেও।

বাংলাদেশের ঘুমঘুম ও উখিয়া সীমান্ত এলাকায় অব্যাহত গোলাগুলির কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। সীমান্তের ভেতরে গোলা পড়ায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কয়েকবার সতর্কও করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে অনেক মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।

রাজধানীতে কারফিউ
দেশজুড়ে সংঘাত পরিস্থিতিতে রাজধানী নেপিদো এবং আশেপাশের শহরগুলোয় রাতে কারফিউ জারি করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত শহরে চলাফেরা করা যাবে না। সেইসাথে চারজনের বেশি একত্র হওয়া যাবে না। কোনোরকম বিক্ষোভ বা প্রকাশ্য বক্তব্য দেয়া যাবে না।

থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদপত্র ইরাবতি জানিয়েছে, কারফিউয়ের পাশাপাশি রাজধানীতে বাঙ্কার তৈরি করছে সামরিক বাহিনী। এছাড়া পুলিশের নতুন নতুন চৌকি তৈরি করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে।

বিশেষ করে যেসব এলাকায় সামরিক বাহিনীর সদস্য বা পরিবার বসবাস করে, সেসব এলাকায় চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ও বার্তা সংস্থাগুলোর খবর অনুযায়ী, সহিংসতাপ্রবণ এলাকাগুলো ছাড়াও মিয়ানমারের অসংখ্য শহরে কারফিউ এবং মানুষজনের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে সামরিক বাহিনী। মঙ্গলবার তারা নতুন একটি আইন জারি করেছে যে, সামাজিকমাধ্যমে সরকারবিরোধী কোনো পোস্টে লাইক বা শেয়ার করা হলেও কারাদণ্ড দেয়া হবে।

বিদ্রোহীদের বৈঠক, সরকোরের রণকৌশল বদল
ইরাবতি জানিয়েছে, সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের শীর্ষ সাতটি সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্যরা ওয়া রাজ্যের পাংসাংয়ে আজ (বুধবার) বৈঠকে বসতে যাচ্ছে।

কোভিড মহামারীর পর এই প্রথম এসব গোষ্ঠীর নেতারা একত্রে বৈঠকে বসছেন। এসব গোষ্ঠীর প্রায় ৩০ হাজার সদস্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

আরাকান আর্মির একজন মুখপাত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনের কারণেই তারা বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন এবং সেখানে মূল্য লক্ষ্য হবে নিজেদের মধ্যে একতা আরো বৃদ্ধি করা।

বিবিসির বার্মিজ সার্ভিস জানিয়েছে, এখন উত্তর রাখাইন রাজ্য, চিন রাজ্য, শান ও কাচিন এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে বার্মিজ সেনাবাহিনী। তারা ভারী অস্ত্র ও ট্যাঙ্কের সহায়তা অনেকগুলো শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

তারা সেখানকার একাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে।

বিবিসির বার্মিজ সার্ভিস বলছে, সাধারণ জনগণের ওপর সামরিক বাহিনীর ভারী অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের রণকৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

যেখানে সম্প্রতি এই হামলার ঘটনা ঘটেছে সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মান জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যাই বেশি।

ফলে এদের মধ্যে থেকে বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে সামরিক সরকারের প্রতি তাদের মনোভাব বদলে যাচ্ছে।

এদিকে ইরাবতি জানিয়েছে, অব্যাহত যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়া থেকে চারটি সুখই ফাইটার জেট বিমান পেতে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র এই খবর দিয়েছেন। ২০১৮ সালের একটি চুক্তি অনুযায়ী এর আগে দুইটি জেট বিমান সরবরাহ করেছে রাশিয়া।

ইরাবতি খবর দিয়েছে, আরাকান আর্মি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ১০০ জনের বেশি সৈনিক ও অফিসার পক্ষ ত্যাগ করে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন অফিসার রয়েছে।

অন্যদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে আরাকান আর্মির কয়েকটি ঘাঁটি তারা দখল করে নিয়েছে।

যদিও বিবিসির পক্ষ থেকে এসব তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

রাখাইনের মংডু এবং পালেতয়া শহর ঘিরে সড়ক এবং নৌপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফলে সেসব এলাকায় খাবার ও জরুরি সামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে।

সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে।

যেভাবে সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিস। মিয়ানমারের সংঘাতের পুরো ঘটনা নিয়ে তারা একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সেখানে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে ব্যাপক সহিংসতার সূত্রপাত হয় ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন গণতন্ত্রপন্থী অং সান সু চি’র সরকারকে উৎখাত করা হয়।

কিন্তু দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আর আগের মতো সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চায়নি। ফলে তারা দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও আন্দোলন করতে শুরু করে, যেখানে অংশ নিয়েছিল প্রধানত তরুণ গোষ্ঠী আর গণতান্ত্রিক সরকারের কর্মীরা। পরে তাদের সাথে যুক্ত হয় ক্ষমতাচ্যুত ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নির্বাচিত অংশটি।

স্থানীয় বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, নাগরিক সমাজ, ক্ষমতাচ্যুত জনপ্রতিনিধি আর জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদের একটি সরকার গঠন করে, যার নাম দেয়া হয় ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। তাদের প্রতিনিধি দলের সাথে প্রকাশ্যে দেখা করেছেন আসিয়ান ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

মতপার্থক্য নিরসন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এনএলডি, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি আর সরকার বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও জাতিগত গোষ্ঠগুলো মিলে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে আরেকটা জোট গঠন করে, যার নাম দেয়া হয় ন্যাশনাল ইউনিটি কনসালটেটিভ কাউন্সিল (এনইউসিসি)।

কিন্তু গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর যখন সামরিক বাহিনী দমন-পীড়ন শুরু করে, তখন তাদের অনেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে সহায়তা ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর তারা সারা দেশের গণতন্ত্রপন্থীদের সংঘটিত করে একটি বাহিনী গঠন করে, যার নাম দেয়া হয় পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)।

মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোর শহর, নগর আর গ্রামে তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২০২১ সালের অক্টোবর নাগাদ দেশের সব শহর এলাকায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করে পিডিএফ।

এই অস্থিরতার সুযোগে মিয়ানমারের আরাকান, কাচিন, কারেন, শান এবং ওয়া বাহিনীর মতো ১১টি জাতিগত গোষ্ঠী, যারা বহুদিন ধরে মিয়ানমারের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তারা নিজেদের আধিপত্য এবং দখল বাড়ানোর জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করে। তাদের সাথে যোগ দিয়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে সামরিক অভিজ্ঞতা লাভ করে পিডিএফের যোদ্ধারাও।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক সুবীর ভৌমিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মিয়ানমারের এক বছরের বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আছে। কিন্তু এই সময়ে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বহুকাল ধরে কিছু উপজাতীয় গোষ্ঠীর সাথে, কাচিন, কারেন, শান- তাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে তাদের লড়াই চলছিল। কিন্তু এখন জোর করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন রুখতে গিয়ে, বার্মিজদের মধ্যে, যারা মূল জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রবণতা বেড়েছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারাও সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে গেছে।’

তিনি বলেছেন, রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগ বন্ধ করে দেয়ার কারণে মূল বার্মান জনগোষ্ঠী, যারা এর আগে অস্ত্র হাতে নেয়নি, তারা এখন সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছে। এদের মধ্যে সবগুলো রাজনৈতিক দল ছাড়াও সুশীল সমাজের লোকজন রয়েছেন।

সেনাবাহিনীতে পক্ষত্যাগ
এসব বিদ্রোহ দমন করতে ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করতে শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষ তাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হয়েছে।

ফলে এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে একইসাথে বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশগুলোয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে, তেমনি দেশের ভেতরের বিভিন্ন প্রদেশে গণতন্ত্রপন্থী পিডিএফ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে।

সুবীর ভৌমিক বলছেন, ‘এই বহুমুখী সশস্ত্র আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে যেভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে, তাতে তারা কোনো জায়গাতেই ঠিকমতো সামলাতে পারছে না।’

তিনি বলছেন, সেনাবাহিনীর ভেতরের অবস্থাও খারাপ। সেনাবাহিনী থেকে প্রচুর সৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে জুনিয়র অফিসার এবং সৈনিক- তাদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা গেছে, তারা সেনাবাহিনী ছেড়ে সরাসরি পিডিএফে যোগ দিচ্ছে, কেউ পালিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সহিংসতা এখন প্রায় একটি গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সেনাবাহিনী একের পর এক গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। কিন্তু সেইসাথে জাতিগত বাহিনীগুলা ও পিডিএফ আরো বেশি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছে, তাদের সামর্থ্য, যোগাযোগ আর সক্ষমতাও বাড়ছে। অনেক এলাকায় সরকারি শাসন ভেঙে পড়েছে।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে চায় সামরিক জান্তা। এর আগে তারা দেশে নিজেদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বলে মনে করে ইনস্টিটিউট অফ পিস।

সূত্র : বিবিসি

Exit mobile version